ধর্ম প্রশ্নে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে পার্থক্য কি? না, কোনো পার্থক্য নাই। ধর্ম প্রশ্নে উভয় মতবাদই অভিন্ন মত ধারণ করে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রবাদ উভয়ই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ অগ্রজ, সমাজবাদ অনুজ। উভয়ের মধ্যে পার্থক্যের জায়গা হল সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে। পুঁজিবাদ সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় বিশ্বাস করে আর সমাজবাদ সামাজিক মালিকানায়। পুরানা সংস্কার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতাকে নির্মমভাবে ছিন্ন-ভিন্ন করে বুর্জোয়া শ্রেণির হাত ধরে পৃথিবীতে প্রথম আধুনিকতার প্রসার ঘটে পশ্চিম ইউরোপে।
’ইতিহাসের দিক থেকে বুর্জোয়া শ্রেণি খুবই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি শোভন সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। যে সব বিচিত্র সামস্ত বাঁধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার স্বভাবসিদ্ধ ঊধ্বর্তনদের কাছে, তা এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের অনাবৃত স্বার্থের বন্ধন, নগদ টাকার বাঁধন ছাড়া আর কিছুই এরা বাকি রাখেনি। আত্মসর্বর্স্ব হিসাব-নিকাশের বরফ জলে এরা ডুবিয়ে দিয়েছে ধর্ম-উন্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যবৃত্তির উৎসাহ ও কূপমণ্ডুক ভাবালুতা। লোকের ব্যক্তিমূল্যকে এরা পরিণত করেছে বিনিময়মূল্যে, অগণিত অনিস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধীনতাকে এরা পরিণত করল ওই একটি মাত্র নির্বিচার স্বাধীনতায়, যার অর্থ হল — অবাধ বাণিজ্য। এক কথায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রমে যে শোষণ এতদিন ঢাকা ছিল, তার বদলে এরা এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সাক্ষাৎ পাশবিক শোষণ।’
মধ্যযুগের শেষ নাগাদ অটোম্যান সাম্রাজ্যের নেতৃত্বে ইউরোপজুড়ে ইসলামিক দুনিয়ার বিস্তার ঘটতে থাকে। ইসলামিক শক্তির আগ্রাসন আতঙ্কে কাঁপছিল ইউরোপ। অটোম্যানদের দখলে চলে যায় পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা। এই বাস্তবতায় ইউরোপকে দাঁড়াতে হয়েছে ইসলামকে মোকাবেলা করেই।
অপর দিকে পশ্চিম ইউরোপ, যেখান থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণি, যে বুর্জোয়া শ্রেণি আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফজলে ডুবিয়ে দেয় ধর্ম-উম্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যবৃত্তির উচ্ছ্বাস ও ককূপমণ্ডুক ভাবালুতা।
সেই বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিজ দেশে যে ধর্মীয় কুসংস্কারকে মোকাবেলা করতে হয়েছে, তখন তার সামনে ছিল খ্রীষ্টীয় ধর্ম। তাই তাকে ইসলামের অসঙ্গতিকে উম্মোচন করতে হয়নি।
অপরদিকে ইসলামি জগতের আগ্রাসন মার খাওয়ায় পর, তার বিলয় ঘটতে থাকে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানে। এরপর ইতিহাসের দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয় ইসলামি দুনিয়ার উত্থানপর্ব।
এসকল ঘটনাপর্বে নিঃশেষ হওয়ার পরিণতি থেকে ইসলামকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে বুর্জোয়া শ্রেণি, ততদিন তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
সাম্রজ্যবাদী শক্তি ও ইসলামি শক্তি সব সময় পরস্পরের পরিপূরক হয়েই কাজ করেছে।
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় শ্রমিক বিপ্লব সংঘটনের পর বিশ্বজুড়ে বুর্জোয়া শ্রেণির বুকে কাঁপন ধরে যায়। আসন্ন শ্রমিক বিপ্লবের হাত থেকে বিশ্ব পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসে ইসলাম।
এশিয়া-ইউরোপ-ল্যাটিন আমেরিকা-আফ্রিকার কত দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল, কিন্তু ইসলামি দুনিয়ার কোথাও সমাজতন্ত্র অভিমুখী শ্রমিক বিপ্লব সংঘটিত হয়নি।
ইসলামপন্থী দলসমূহ তাদের ধর্মীয় অনুশাসনের কল্পিত সমাজ গড়তেই রাজনীতি করেছে, যে সমাজ শেষবিচারে মুনাফা ভিত্তিক ও ব্যক্তি মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজই বটে। শুরু থেকে ইসলাম পণ্য অর্থনীতি এবং আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই ঘোরতর সমর্থক হয়ে থেকেছে। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী দলগুলো যে সবসময় প্রগতিশীল আন্দোলনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে কিংবা নিকৃষ্ট গণশত্রুদের হাত ধরে চলেছে, — এমন উদাহরণ প্রচুর পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষে থেকেছে এমন উদাহরণ একটিও পাওয়া যাবে না।
কুখ্যাত জেনারেল ইয়াহিয়ার পাশে ছিল জামায়াত, আরেক গণশত্রু জেনারেল এরশাদের সঙ্গে ছিল আটরশির পীর। ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের প্রধান চর মোনাইয়ের পীরও এরশাদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল জামায়াত নেতা গোলাম আজম সহ বিভিন্ন ইসলামিক দল। ইসলামপন্থীরা সাতচল্লিশে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল, অদূর অতীতে সংগঠিত হয়েছিল খালেদা জিয়ার ছায়ায়।
বাংলাদেশের বাইরে আফগানিস্তান, ইরাক, ইরানে ও পাকিস্তানে ইসলামিক শক্তি সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন করছে। খোদ সৌদি আবরই টিকে আছে মাকিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকম্পায়।
আফগানিস্তানে আশির দশকে সোভিয়েত হস্তক্ষেপে গঠিত হয়েছিল সামাজতান্ত্রিক’ সরকার। ওই সরকারের পতনের জন্য মার্কিনী অস্ত্রে-অর্থে-বন্ধুত্বে বলীয়ান হয়ে উঠে-পড়ে লেগেছিল সেদেশের ইসলামপন্থী দলগুলো। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার প্রপাগাণ্ডাার মার্কিনী মুখপাত্রে পরিণত হয়েছিল তারা।
সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে ইসলামপন্থী দলগুলো। এর কারণ কি সমাজতন্ত্র নাস্তিক্যবাদী দর্শন বলে? পুঁজিবাদ নিজেও একটি নাস্তিক্যবাদী আধুনিক মতাদর্শ। ধর্ম প্রশ্নে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য হল, পুঁজিবাদ ভণ্ডামীর আড়ালে ধর্মের অন্তঃসারশূন্যতাকে লুকিয়ে রাখে আর সমাজতন্ত্র তাকে উন্মোচিত করে দেয়। নাস্তিক্যবাদ উছিলা মাত্র, ইসলামের সঙ্গে পুঁজিবাদের সখ্যর মূল জায়গা হল সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা। কারণ মুনাফা, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং অবাধ শোষণ-লুণ্ঠনের সঙ্গে ইসলামের গভীর যোগসুত্র রয়েছে।
আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকজুড়ে ইসলামিক স্কলাররা যে বক্তব্য রাখতেন, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রপাগাণ্ডা। গ্রামগঞ্জের ধর্মসভাগুলোতে সামজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সীমাহীন বিষোদ্গার করা হত। মোল্লা বা আলেমরা সমাজতন্ত্রের বিকৃত উপস্থাপন ও অপব্যাখ্যা দিয়ে চলতেন। এমনকি বুর্জোয়া দলগুলোও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এত উচ্চকণ্ঠ ছিল না। এসব ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে ছিল সামরিক সরকারগুলোর গভীর সখ্য। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু নয়, মসজিদ, মাদরাসা ও অরাজনৈতিক ধর্মসভাগুলো ছিল সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রপাগাণ্ডার আখড়া। সমাজতন্ত্র ও কমিউনিস্টরা ছিল তাদের টার্গেট। জামায়াত-শিবিরের হামলায় নিহতদের বেশিরভাগই বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী।
এবার বাংলাদেশের বাইরের প্রসঙ্গে আসা যাক। যে গণ-অভ্যুত্থান দ্বারা ইরানের সম্রাট রেজাশাহ পাহলভী উচ্ছেদ হলেন, সেখানে কমিউনিস্টদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহণ ছিল। ইরানের তু দে পার্টি ওই অভ্যুত্থানে বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিল। ইসলামপন্থী দল এবং খোমেনীর সঙ্গে একটি সমঝোতাও তৈরি হয়েছিল। অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কমিউনিস্ট নিধন শুরু করে খোমেনীর দল। মুসলিম জনসমাজও কমিউনিষ্ট নিধন যজ্ঞ সমর্থন করে। ইন্দোনেশিায়ার দেশপ্রেমিক সুকর্ণ সরকারকে উচ্ছেদ করতে এগিয়ে এসেছিল ইসলামপন্থী দলগুলো। হাত মিলিয়ে ছিল কুখ্যাত স্বৈরশাসক জেনারেল সুহার্তোর সঙ্গে। চীন বিপ্লবের পর সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়া চিয়াং কাইশেক ও তার দল, বেলুচিস্তানের কসাই বলে খ্যাত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ঘাতক প্রধান জেনারেল টিক্কা খানসহ এশিয়ার তাবৎ কুখ্যাত প্রতিক্রিয়াশীলরা জড়ো হয়েছিল, তারা সুকর্ণের সহযোগী কমিউনিস্ট নিধনযজ্ঞে মেতে উঠেছিল। ওই ঘটনায় প্রায় ১০ লক্ষ কমিউনিস্ট ও মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, ট্রেড ইউনির্নিস্টসহ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
এই গণহত্যা পরিচালনাকারী সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল ইসলামপন্থী দল ও জনতা। একাত্তরে বাংলাদেশেও পাকহানাদাররা যে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ করেছিল সেটাও ইসলামিক জোশেই।
ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যে ধর্ম একটা জনগোষ্ঠীকে অসহিষ্ণু ও কুপমণ্ডুকে পরিণত করে। একই সঙ্গে সেই জনগোষ্ঠীক ধর্ষণ ও গণহত্যায় উৎসাহিত করে তোলে।
তাই ইসলাম ও ধর্ষণ সমার্থক, ইসলাম ও প্রতিক্রিয়াশীলতা সমার্থক, ইসলাম ও চাপাতি সমার্থক, ইসলাম ও গণহত্যা সমার্থক। কিন্তু ইসলাম ও প্রগতি সমার্থক নয়।
রাষ্ট্র প্রধান ধর্ষক হলেও সাধারণ মুসলমান সেটা মেনে নেয় এবং বলতে পারে, ’রাজা-বাদশারা ও রকম একটু করেই থাকে।’
২০১০ সালের নাইন বাই ইলেভেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায় ইসলামিক জঙ্গিদের দায়ী করা হয়। তাদের শায়েস্তা করার জন্য আফগানিস্তানে হামলা চালায় মার্কিন সাম্রজ্যবাদ ও তার সহযোগীরা। এর আগে ইরাক ও দখল করে নেয়া হয়।
এই হামলা ও দখলদারিত্বকে নাম দেয়া হয় ’ওয়ার অন টেরর’। ইসলামিক জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের দমন করার জন্যই ‘ওয়ার অন টেরর’ শিরোনামের হামলাকে ব্যাপকভাবে প্রচারণার নিয়ে আনা হয়।