বর্তমান যুগে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বা AI (Artificial Intelligence) একটি অত্যন্ত পরিচিত শব্দ। আমরা প্রায় প্রতিদিনই এর ব্যবহারের সাথে পরিচিত হচ্ছি। তবে অনেকের কাছে এখনও “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” একটি রহস্যময় বিষয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হলো এমন একটি প্রযুক্তি যা মেশিন বা কম্পিউটার সিস্টেমকে মানুষের মতো চিন্তা, শিখতে এবং সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম করে। “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” এমন একটি প্রযুক্তি যার মাধ্যমে কম্পিউটার মানুষের মতো কাজ করতে পারে, যেমন- চিন্তা করা, ভাষা বোঝা, শিখা, সমস্যা সমাধান করা ইত্যাদি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাস
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিহাস বেশ পুরনো হলেও এর ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক কয়েক দশকে। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ডার্টমাউথ কলেজে প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গবেষকরা AI তৈরি করার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু করেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি শুরুর দিকে পা রাখে। এর পরবর্তী বছরগুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান টুরিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধারণাকে আরও এগিয়ে নেন। তিনি “টুরিং টেস্ট” নামক একটি পরীক্ষা তৈরি করেন, যা দিয়ে কোনো মেশিনের বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর মাধ্যমে AI এর গবেষণার ভিত্তি স্থাপন করা হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় অ্যালান টুরিং–এর অবদান
অ্যালান টুরিং ছিলেন একজন ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী এবং গাণিতিক তাত্ত্বিক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনকদের অন্যতম। । তাঁর অবদান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তত্ত্ব এবং প্র্যাকটিক্যাল অ্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টুরিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজগুলির মধ্যে একটি হল “টুরিং টেস্ট”। টুরিং টেস্ট হল এমন একটি পরীক্ষা যা নির্ধারণ করে যে, একটি মেশিন কি মানুষের মতো চিন্তা করতে সক্ষম কিনা। এই পরীক্ষা একটি কম্পিউটার এবং একজন মানব ব্যক্তির মধ্যে কথোপকথনের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। যদি মানব ব্যক্তি কম্পিউটারকে শনাক্ত করতে না পারে, তবে তাকে মনে করা হয় যে, কম্পিউটার “বুদ্ধিমান”। টুরিং কম্পিউটিং এর তত্ত্বে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন, যা “টুরিং মেশিন” নামে পরিচিত। এটি একটি কাল্পনিক যন্ত্র যা কোনো গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে পারে, যদি তার কাছে যথেষ্ট সময় এবং তথ্য থাকে। এই ধারণাটি কম্পিউটার বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি স্থাপন করে এবং আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। টুরিং এর এই প্রাথমিক গবেষণা এবং উদ্ভাবন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং কম্পিউটারের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে, এবং আজকের দিনে এটি বিভিন্ন প্রযুক্তি, যেমন মেশিন লার্নিং, অটোমেশন এবং অন্যান্য সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রগুলিতে ব্যবহার হচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা ব্যাপক। এর মাধ্যমে মানুষের অনেক কঠিন কাজ সহজ করা সম্ভব। বিভিন্ন ক্ষেত্রে AI ব্যবহার হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে এটি আরও বিস্তৃত হবে। যেমন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাব্য সমস্যা
যতই AI প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে, ততই এর কিছু সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বেকারত্বের সম্ভাব্য প্রভাব
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতি যেহেতু মেশিন ও কম্পিউটারকে মানবীয় কাজের পরিবর্তে সক্ষম করে তুলছে, এর ফলে বেকারত্ব বাড়তে পারে। যখন প্রযুক্তি মানুষের কাজের জায়গা নেবে, তখন শ্রমিকদের জন্য চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্বচালিত গাড়ির প্রযুক্তি যখন বাজারে প্রচলিত হবে, তখন চালকরা, যেমন ট্যাক্সি ড্রাইভার, ট্রাক ড্রাইভার, বাস চালক, তাদের চাকরি হারাতে পারেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এই ধরনের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হওয়ার কারণে, বহু কর্মী অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে যারা কম দক্ষতা সম্পন্ন কাজ করেন।
আরেকটি উদাহরণ হলো গ্রাহক সেবা খাতে AI ব্যবহার। এখন অনেক সংস্থা AI-চালিত চ্যাটবট এবং অটোমেটেড কাস্টমার সার্ভিস সিস্টেম ব্যবহার করছে, যা মানুষের কাজের প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে দিয়েছে। যারা গ্রাহক সেবা বা কল সেন্টার এর মতো চাকরি করেন, তাদের জন্য এখন চাকরি হারানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়া, উৎপাদন শিল্পেও AI প্রযুক্তির আগমন বিশেষভাবে শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করেছে। রোবট এবং মেশিন এখন উৎপাদন প্রক্রিয়া অনেক দ্রুত এবং সঠিকভাবে সম্পন্ন করছে, যার ফলে কম দক্ষ শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা কমছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরি বা অন্য শ্রমভিত্তিক কাজে AI এর ব্যবহারের ফলে মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে পারে। এই সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন নতুন দক্ষতা অর্জন, পুনরায় প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন সেক্টরে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করা। AI এর উন্নয়ন যতটা প্রযোজ্য, ততটাই মানব সম্পদের উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যাতে মানুষ প্রযুক্তির সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে সক্ষম হয়।
যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন যুদ্ধের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বচালিত ড্রোন, রোবট সেনা, এবং স্মার্ট যুদ্ধ সরঞ্জামগুলোর মাধ্যমে AI সেনাদের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। AI প্রযুক্তি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ, শত্রুর গতিবিধি চিহ্নিতকরণ, এবং অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহায়তা করছে। তবে, এই প্রযুক্তি যুদ্ধকে আরও বিধ্বংসী করে তুলতে পারে এবং মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার
চিকিৎসা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। AI এখন রোগ নির্ণয়ের প্রক্রিয়া সহজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন রকম স্ক্যান বা পরীক্ষা বিশ্লেষণ করতে AI অত্যন্ত দক্ষ। বিশেষ করে ক্যানসার, মস্তিষ্কের সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো জটিল রোগগুলির পূর্বাভাস দিতে AI ব্যবহৃত হচ্ছে। AI এমনকি রোগীদের চিকিৎসা ইতিহাসও বিশ্লেষণ করতে পারে এবং ডাক্তারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগুলো AI-এর মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে বড় তথ্য বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হচ্ছে, যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে আরো দ্রুত ও কার্যকর সেবা প্রদান করতে সাহায্য করছে।
উপসংহার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা বিপুল, তবে এটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। এই প্রযুক্তি যেন মানুষের জন্য উপকারী হয় এবং কোনো ক্ষতির কারণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। AI আমাদের জীবনের অনেক দিকেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম, তবে এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা একটি উন্নত, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যত তৈরি করা সম্ভব। ।