লোকশ্রুতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন
কুম্ভমেলা—হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রাচীন উৎসব। লোকশ্রুতি অনুসারে, দেবতা ও অসুরের যুদ্ধকালে অমৃতের কলস থেকে বারো ফোঁটা অমৃত গড়িয়ে পড়েছিল চারটি স্থানে: হরিদ্বার, প্রয়াগরাজ (পুরানো নাম এলাহাবাদ), নাসিক ও উজ্জ্বয়িনী। প্রাচীনকালের সেই ঘটনার স্মৃতি ধরে রাখতে আদি শঙ্করাচার্যের উদ্যোগে প্রতি বারো বছর অন্তর এই চারটি স্থানে কুম্ভমেলা আয়োজিত হয়। কুম্ভমেলার প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের লেখা থেকে, যিনি রাজা হর্ষবর্ধনের আমলে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। এই বছর প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলা শুরু হয়েছে ১৫ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তির দিন থেকে এবং চলবে ৪ মার্চ মহা শিবরাত্রি পর্যন্ত। আট সপ্তাহব্যাপী এই বিশাল আয়োজনে আয়োজকদের দাবি, প্রায় ১৫ কোটি দর্শনার্থী, যার মধ্যে ১০ লক্ষের বেশি বিদেশি, উপস্থিত হয়েছেন।
কুম্ভমেলায় সাধুদের বিলাসবহুল পদযাত্রা
২০২৫মহাকুম্ভ মেলা উপলক্ষে প্রয়াগরাজে দেখা মিলেছে বিলাসবহুল গাড়ির বহর। এগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন আখড়ার সাধুদের ব্যবহৃত । এই গাড়ি বহরে রয়েছে রোলস রয়েস, অডি, মার্সিডিজ, ল্যান্ড রোভার, টয়োটা ফরচুনা সহ বহু দামি গাড়ি। এসব গাড়ির মূল্য ২৫ লক্ষ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় আখড়ার অনেক সাধুর দাবি, গাড়িগুলো মূলত পীঠাধীশ্বর বা প্রবীণ সাধুদের নামে নিবন্ধিত। শুধু বিলাসবহুল গাড়ি নয়। সিনেমার তারকাদের মতো ভ্যানিটি ভ্যানে চড়ে পুণ্যের কুম্ভে এসেছেন শঙ্করাচার্য স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী। সব মিলিয়ে ত্যাগ আর বিলাসিতা যেন মিলেমিশে একাকার। বিলাসিতা ও পুণ্যের এই মেলবন্ধনে মেলায় উপস্থিত সাধুদের জীবনযাত্রা নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক । সাধারণ পূণ্যার্থীদের জন্য যেখানে মেলা কঠিন হয়ে পড়ে, সেখানে সাধুদের এই বিলাসবহুল প্রদর্শনী অনেকের মধ্যেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তবে এই প্রতিক্রিয়া ব্যাপক নয়। গণসচেতনা তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়।
‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে যোগী প্রশাসন
প্রয়াগরাজ কুম্ভমেলায় পদপিষ্ট হয়ে কমপক্ষে ৩০ জনের মৃত্যু এবং ৬০ জন আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যদিও বেসরকারি সূত্রে হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে দাবি করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, রাত আড়াইটার দিকে ভিড় অতিরিক্ত বেড়ে যায়। সঙ্গমস্থলের লোহার ডাস্টবিন ও ব্যারিকেডে ধাক্কা লেগে অনেকে পড়ে যান। এর পর লোকজনের পায়ের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী উপস্থিত থাকলেও ভিড় নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পূণ্যার্থীরা অভিযোগ করেছেন, কয়েক কোটি মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এটিকে ‘গুজব’ বলে মন্তব্য করলেও পরে প্রশাসন মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে। পুলিশের অভিযোগ, দুই যুবকের ছড়ানো বোমাতঙ্কের কারণে ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
পেছনে ফিরে দেখা: কুম্ভমেলার মৃত্যু মিছিল
ধর্মীয় বিশ্বাসের শক্তি ও ভয়াবহতা
হিন্দু ধর্মমতে, কুম্ভমেলার বিশেষ স্নান, যাকে “শাহি স্নান” বলা হয়, পাপ মোচন ও পূণ্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। এই বছর মৌনী অমাবস্যায় (৪ ফেব্রুয়ারি) তৃতীয় শাহি স্নানের সময় কয়েক কোটি পূণ্যার্থী গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর ত্রিবেণী সঙ্গমে সমবেত হন। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ভেঙে পড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামো। ২৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাত থেকে শুরু হওয়া এই ভিড়ের চাপে পদপিষ্ট হয়ে বহু মানুষ আহত ও নিহত হয়েছেন। উদ্ধারকারীরা আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেলেও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা এখনও জানা যায়নি।
ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অদম্য আস্থা। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ মনে করেন, তীর্থযাত্রায় মৃত্যুবরণ করলে তা পবিত্র মৃত্যু হিসেবে গণ্য হয়। এ ধরনের বিশ্বাস অনেককে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এই বিশ্বাসই প্রায়ই মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনে। বিশৃঙ্খল জমায়েত ও প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনায় তীর্থস্থানগুলোতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। পুণ্য অর্জনের সহজ পথ হিসেবে শুধুমাত্র তীর্থস্নানকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে সৎকর্মের প্রতি আগ্রহ কমছে। এই বিশ্বাস জাতিকে কর্মবিমুখ ও অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। এর ফলে যুক্তিবোধ ও বাস্তবচেতনায় ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশাল অর্থনৈতিক লেনদেন হয়। তথাকথিত ধর্মগুরু ও বাবারা পূণ্য অর্জনের মোহ দেখিয়ে ভক্তদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ আদায় করেন। পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর পরেও তারা দায়মুক্ত থেকে যান। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, এই বছর কুম্ভমেলাকে ঘিরে প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকার ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
শেষ কথা
দুর্ঘটনা জনিত যে কোনো মৃত্যুই ভয়াবহ মর্মান্তিক ! অন্ধ ভক্তদের অন্ধ ভক্তি কিন্তু কিছুই কমবে না। কেউ বলবে যাঁরা ওইখানে মারা গেল তাঁরা সোজা স্বর্গে যাবে আবার কেউ বলবে এতবড় একটা অনুষ্ঠানে এটুকু তো হতেই পারে। ধর্ম নিয়ে অন্ধ বিশ্বাস আর অন্ধ ভক্তি খুবই ভয়ঙ্কর। মানুষের মস্তিষ্ককে অন্য কিছু ভাবতেই দেয় না। প্রতি বছরই কুম্ভমেলার মতো বিশাল আয়োজনে নিরাপত্তার অভাবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ ও জরুরি উদ্ধার ব্যবস্থাপনায় প্রশাসনের ব্যর্থতা এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটাচ্ছে। তবুও এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যায় না।
বিশ্বাসের মোহে আবদ্ধ এই জাতি কবে যুক্তির আলোয় নিজের পথ খুঁজে পাবে, সেই প্রশ্ন এখন কোটি মানুষের মনে। পূণ্যলোভীদের অন্ধ বিশ্বাস কেবল তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই ধারা থেকে মুক্তির জন্য নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা ও যুক্তিবোধ গড়ে তোলা জরুরি।
পশ্চিম বাংলা। ভারত।