সমসমাজ ডেস্ক
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তার সরকার যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের আর নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। তার এই ঘোষণা কার্যত সংবিধানের জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের গ্যারান্টিকে উপেক্ষা করার ইঙ্গিত দেয়। এই আদেশের ফলে আইনগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে যে ২০ ফেব্রুয়ারির পর জন্ম নেওয়া এসব শিশু আর নাগরিকত্ব সংক্রান্ত কোনো নথি পাবে না। এই আদেশের মাধ্যমে ট্রাম্প সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর প্রচলিত ব্যাখ্যা পাল্টে দিয়ে বলেছেন যে সংশোধনীটি কখনোই “যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া প্রত্যেকের জন্য নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যাখ্যা করা হয়নি।” ট্রাম্পের আদেশ অনুযায়ী, যদি কোনো শিশুর মা-বাবা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন, তবে সেই শিশু জন্মগত নাগরিকত্ব পাবে না। এমনকি, যদি শিশুর মা বৈধভাবে সাময়িক ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন এবং বাবা নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা না হন, সেই শিশুও নাগরিকত্ব পাবে না। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে “জন্ম পর্যটন” (birth tourism) বন্ধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিছু নারী যুক্তরাষ্ট্রে শুধু সন্তান জন্ম দিতে আসেন যাতে শিশুটি মার্কিন নাগরিকত্ব পায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের নাগরিকত্ব প্রদানকে অগ্রহণযোগ্য বলে আসছেন। তবে সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে বলে এই আদেশ আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। সংবিধান পরিবর্তন করতে হলে কংগ্রেসে সুপারমেজরিটি (দুই-তৃতীয়াংশ) ভোট প্রয়োজন এবং এরপর যুক্তরাষ্ট্রের তিন-চতুর্থাংশ রাজ্যের অনুমোদন লাগবে।
১৮৬৮ সালে অনুমোদিত সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, “যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ বা প্রাকৃতিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব লাভ করেছেন এবং জাতীয় আইনের আওতায় রয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও তার নিজ রাজ্যের নাগরিক।” এখানে “জাতীয় আইনের আওতায় থাকা” বলতে খুব সীমিত কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। এটি সাধারণত শুধুমাত্র স্বীকৃত বিদেশি কূটনীতিকদের সন্তানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এর বাইরে কারো মা-বাবার নাগরিকত্ব বা অভিবাসন পরিস্থিতি কখনো এই অধিকারের ওপর প্রভাব ফেলে না।
গৃহযুদ্ধের আগে পর্যন্ত মার্কিন নাগরিকত্বের কোনো নির্ধারিত সংজ্ঞা ছিল না। সংবিধানে নাগরিকদের উল্লেখ করা হলেও, কে নাগরিক তা স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। নাগরিকত্বের সংজ্ঞা ও অধিকার নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল প্রতিটি রাজ্যের হাতে। তবে সংবিধান কংগ্রেসকে প্রাকৃতিকীকরণ (naturalization) বা বিদেশিদের নাগরিকত্ব প্রদান ব্যবস্থার ক্ষমতা দিয়েছে। ১৭৯০ সালের এক আইনে প্রথমবার মার্কিন নাগরিকত্বের সংজ্ঞা দেওয়া হয়। যদিও নতুন দেশটি নিজেকে “মানবজাতির আশ্রয়স্থল” বলে দাবি করেছিল, এই আইনে নাগরিকত্ব শুধুমাত্র “মুক্ত শ্বেতাঙ্গদের” জন্য সীমিত করা হয়েছিল। ফলে শুরু থেকেই মার্কিন নাগরিকত্বের ধারণা বর্ণের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল। দাসরা তখন নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতো না। কিন্তু ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পাঁচ লাখ মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ বাস করতেন, যাদের প্রায় সবাই দেশেই জন্মেছিলেন। তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছিল। ১৮৫৭ সালের ঐতিহাসিক ড্রেড স্কট মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেয় যে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি মার্কিন নাগরিক হতে পারবেন না। প্রধান বিচারপতি রজার ট্যানি রায় দিয়ে বলেন, সংবিধানের প্রণেতারা কৃষ্ণাঙ্গদের “অধম শ্রেণির মানুষ” হিসেবে দেখতেন এবং তাদের কোনো অধিকার নেই যা শ্বেতাঙ্গরা সম্মান করতে বাধ্য।
গৃহযুদ্ধের পর দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলে এবং প্রায় দুই লাখ কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে কৃষ্ণাঙ্গদের নাগরিকত্বের প্রশ্নটি জাতীয় ইস্যু হয়ে ওঠে। পুনর্গঠন (Reconstruction) যুগে মার্কিন নাগরিকত্বের প্রথম আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা প্রণয়ন করা হয় এবং নাগরিক অধিকারের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই সময়ই জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের নীতির প্রতিষ্ঠা হয়, যা জাতিগত বা বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে প্রত্যাখ্যান করে। ১৮৬৬ সালের জুন মাসে কংগ্রেস ১৪তম সংশোধনী অনুমোদন করে এবং রাজ্যগুলোতে পাঠায়। এই সংশোধনীর প্রথম অংশে বলা হয়, “যে কেউ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ বা প্রাকৃতিকীকরণের মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এবং জাতীয় আইনের আওতায় রয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও নিজের রাজ্যের নাগরিক।” কংগ্রেসের বিতর্কে উল্লেখ করা হয় যে এটি মূলত নেটিভ আমেরিকানদের বাইরে রাখতে বলা হয়েছে। এছাড়া আরও দুটি ছোট্ট ব্যতিক্রম উল্লেখ করা হয়: কূটনীতিকদের সন্তান এবং দখলদার বাহিনীর সদস্যদের সন্তান। ১৪তম সংশোধনীর মূল উদ্দেশ্য ছিল ড্রেড স্কট মামলার সিদ্ধান্তকে অকার্যকর করা। তবে এর ভাষায় কোনো বর্ণবৈষম্যের কথা নেই। এটি এমন একটি নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল যা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিছু বিরোধী সদস্য চীনা ও “যাযাবর” (gypsies) সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব নিয়ে আপত্তি তোলেন। কিন্তু সেনেট বিচার বিভাগীয় কমিটির চেয়ারম্যান লায়ম্যান ট্রাম্বুল স্পষ্ট করে বলেন, “সব ব্যক্তি” মানে সত্যিই সবাই। চীনা বা যাযাবর যেই হোক, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলে তিনি নাগরিক হবেন।
১৮৬৬ সালে “অবৈধ অভিবাসী” বলে কোনো ধারণা ছিল না। তখন প্রায় সবাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারতেন। পরবর্তী সময়ে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীকে (যেমন যৌনকর্মী, বহুবিবাহকারী, উন্মাদ, বিশৃঙ্খলবাদী এবং ১৮৮২ সাল থেকে চীনারা) যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫০,০০০ চীনা বাস করতেন, যাদের কেউই নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য ছিলেন না। কিন্তু সংশোধনীটির প্রণেতারা এবং পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলো পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে যে এইসব চীনা নাগরিকদের সন্তানরাও মার্কিন নাগরিকত্ব পাবেন। সন্তানের নাগরিকত্ব নির্ধারণে পিতামাতার আইনি অবস্থান কোনো প্রভাব ফেলে না। এখানে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ ভালো আমেরিকান হতে পারে। কিন্তু আজ রিপাবলিকানরা সেই নীতিই পরিবর্তন করতে চাইছেন।