সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার কালনী নদীর তীরে উজানধল গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো দুদিনব্যাপী ‘শাহ আবদুল করিম লোক উৎসব ২০২৫’। উৎসবটি শুরু হয় গত শুক্রবার এবং শেষ হয় শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি। রাতে বাউল গানের পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। এই উৎসব প্রতিবছর আয়োজন করে শাহ আবদুল করিম পরিষদ, যা ২০০৬ সাল থেকে মহান বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের স্মরণে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারের উৎসবটি ছিল করিমের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত। উৎসবে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজারো দর্শনার্থী ও ভক্তরা অংশগ্রহণ করেন। কালনী নদীর তীরে সাজানো হয়েছিল বাউল গানের আসর। উজানধল গ্রামের মাঠে বসেছিল এক বিশাল মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্তরা তাঁবু গেড়ে উৎসবস্থলে রাত কাটিয়েছেন। প্রতিটি পরিবেশনা ও আলোচনায় ফুটে উঠেছে করিমের জীবনের নানা দিক এবং তার গানের সমাজচেতনা। তার গানে উঠে এসেছে ভাটি বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, সামাজিক বৈষম্য এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা।
শাহ আবদুল করিম সব সময়ই কৃষক-মজুরদের জীবনসংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। তার গানেই আমরা পাই শোষণহীন সমাজব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি লিখেছেন—
শাহ আবদুল করিম জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান করিম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। তবে তিনি লোকজ সংগীতের মধ্যে দিয়ে এক অনন্য জীবন গড়ে তুলেছিলেন। তার গান ছিল প্রেম, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি তার জীবদ্দশায় প্রায় ১,৫০০টিরও বেশি গান রচনা করেছেন। তার গানে উঠে এসেছে সমাজের অসাম্য এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গানের মাধ্যমে সোচ্চার হয়েছিলেন। তার এই সাহসী অবস্থানের জন্য একাধিকবার তাকে অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি একসময় তাকে নিজ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। তবে সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি কখনো সংগীত সাধনা ছাড়েননি। বরং তার গানের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষের মনে জাগ্রত করেছেন শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন। ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন শাহ আবদুল করিম। তার কিছু বিখ্যাত গান আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়:
লোকজ সংস্কৃতি ও কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা: পরিবর্তনের ধারা
লোকজ সংস্কৃতি একসময় ছিল গ্রামীণ মানুষের হৃদয়ের গভীর অংশ। এটি তাদের জীবনযাত্রা, বিশ্বাস, সংগ্রাম এবং উৎসব-অনুষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এই লোকজ সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করেছে। এবারের লোক উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ। এই ধরনের কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্যই লোকজ সংস্কৃতির আয়োজনকে অর্থায়ন এবং প্রসারের সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু এর পাশাপাশি একটি উদ্বেগও তৈরি হয়— কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের ফলে লোকজ সংস্কৃতির মূল চেতনা ও আত্মা ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়শই পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে শহুরে পরিবেশ ও মানদণ্ডে রূপ দিতে চায়। এর ফলে ঐতিহ্যের মূল ভাবনা, সরলতা এবং মানুষের সঙ্গে এর আন্তরিক সংযোগ নষ্ট হতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে লোকজ সংস্কৃতির চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে হলে কর্পোরেট প্রভাবের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতা থাকা সত্ত্বেও যেন উৎসবের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের চেতনায় কোনো পরিবর্তন না আসে, তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। শুধু অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নয়, লোকজ সংস্কৃতির সত্যিকার মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখাটাই এই ধরনের আয়োজনের সার্থকতা।