বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫২ পূর্বাহ্ন

কাল নয় সকাল হোক ………. বুলবুল তালুকদার

বুলবুল তালুকদার
শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

“Animall Farm” নিশ্চয়ই বহুজনে এই বইটির কথা শুনে থাকবেন বা পড়ে থাকবেন। George Orwell এর লেখা এই বইটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিক্রিত একটি বই। এক সময়ে বইটির বিক্রি এতটাই বৃদ্ধি হয়েছিল যে, প্রকাশনাগুলো কাগজের সংকটে পড়েছিল। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তেই বিপ্লব ঘটে তখন এই বইটি সামনে চলে আসে এবং এই বইটি পড়ার জন্য পরামর্শ আসে। কি আছে বইটিতে ? বিপ্লব কাহিনী বা কিভাবে বিপ্লব ঘটাতে হয় ? বা কিভাবে বিপ্লব থামাতে হয়? কিংবা করণীয় কি? ইত্যাদি এমন কিছু আছে কি? না, তেমন কিছুর সমাহার এই বইটিতে নেই। যা আছে তা স্রেফ একটি কল্পিত গল্প। কল্পিত গল্প বললে কম বলা হবে। বলতে হয় একটি অতি কল্পিত গল্প। যার সাথে মানুষ জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। নেই বিশ্বের কোন প্রান্তের কোন বিপ্লবের ইতিহাস। এমনকি এতটাই কল্পিত গল্প যে, অমন গল্পের সম্ভাবনাও পৃথিবীতে হবার নয়। তবুও কেন এত পঠিত এই বই?  কারণ বইটির অতি কল্পিত গল্পটি একটি বিপ্লব এবং বিপ্লব পূর্ববর্তী ও পরবর্তী নিয়ে, কেন ঘটে? কি ঘটে অবশেষ? কি তার ফল দেয়? তেমন কিছুই এই গল্পে। আমাদের সময়কালে দেশে থাকতে এমন বই পড়াতো দূরের কথা, যোগাড় করাটাও ছিল অসম্ভব।  ভাগ্যক্রমে বইটি বৈদেশে আসার পরে জার্মান ভাষায় আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে এবং বাস্তবিক অর্থেই বিপ্লব ও ফলাফল কাল্পনিক হলেও অনুধাবন বেশ হয়েছে। কি আছে অতি কল্পিত গল্পে ?
গল্পটি পুরোটা বলতে গেলে বইটির সমপরিমাণ লেখা প্রয়োজন হবে। ওটা সম্ভব নয়। তবে ছোট্ট করে কল্পিত গল্পটির শানেনযুলটা বলার চেষ্টা করি। ইংল্যান্ডের কোন এক কৃষক (Farmer) এর একটি খামার (Farm) ছিল। যেখানে কিছু পশু- পাখি যেমন ঘোড়া- গরু- হাঁস- মুরগি ছিল এবং কৃষক খেত খামারে চাষাবাদ সহ পশু – পাখি লালন- পালন করে জীবিকা চালাতো। কল্পিত সেই গল্পে কোন এক সময় নানান কাহিনীর মধ্য দিয়ে বন জঙ্গল সহ সেই কৃষকের খামারের সকল পুশু- পাখীরাও মিলে একযোগে বিপ্লব ঘটিয়ে কৃষককে তার খামার থেকেই ভয়ানকভাবে বিতাড়িত করে দেয়। অতঃপর কোন এক সময়ে পশু- পাখিরা নিজেদের পরিচালনা করে। নিজেদের পরিচালিত করতে গিয়ে নানান ধরণের ঝামেলার সম্মুখীন হয়। শত সমস্যার সমাধান করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তবুও চেষ্টার ত্রটি করে না।  গল্পের শেষে দেখা যায় যে শুকুরেরা গরুর দুধ খেয়ে নিজেদের বুদ্ধিমান বানায় এবং উচ্চ পর্যায়ে বুদ্ধিমান পশুতে রূপান্তরিত হয়, সেই শুকুরাই আবার মানুষের মতন করে সৈন্য সামান্ত দ্বারা নিরাপত্তা বেষ্টিত হয়ে অন্য সকল পশুদের ভয়ানকভাবে শাসন করে। কল্পিত গল্পে সৈন্য- সামান্ত হয়ে প্রকাশ পায় জঙ্গলের ভয়ানক কুকুরেরা। আর শুকুরেরা এক সময়ে যে গরুর দুধ পান করে বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিল এবং এতটাই বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছিল যে, সেই শাসক শুকুরেরা বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসের জীবন যাপন করার জন্য মদ তৈরী করে এবং বিশাল সিংহাসনে বসে মদ পান করে আর সকল পশুদের শাসন করে। এই ছিল মূল গল্প।
কল্পিত সেই গল্প থেকে আসুন বাস্তব জীবনে ফিরি। গতিশীল বা গতিময় পৃথিবীতে সব কিছুর সাথে গতির একটা নিবিড়, নিচ্ছিদ্র ও পুরূ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। গতির সাথে পাল্লা দিয়ে এগুতে না পারলে কোন এক সময় যোজন যোজন দুরত্বে পিছিয়ে পড়াটাই হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। বর্তমান সময়ে গতির সাথে তাল মেলাতে না পারলে যে কোন রাষ্ট্রের জন্যই এই  ব্রক্ষ্মাণ্ডের স্বাভাবিক অংশ হয়ে থাকাটা বেশ মুশকিল হয়ে উঠবে।  একটি বিষয় বেশ লক্ষ্যণীয যে, বিশ্ব এত গতিময় হয়ে উঠার পরেও বিশ্বকে পরিচালনা করে রাজনীতি এবং বলাই বাহুল্য যে, রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হওয়াটা মানুষ জীবনের জন্য একপ্রকার সৌভাগ্য কেননা এই রাজনীতিটা আবার পরিচালিত হয় মানুষ দ্বারা। অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের পরিচালনা মানুষই করে। মানুষ দ্বারা মানুষ পরিচালিত হয়, এটাকে কেন সৌভাগ্য বলছি ?
বর্তমানের বুদ্ধিমান পৃথিবীতে (intelligent world) এ প্রযুক্তি (Technology) একটি বিরাট ভূমিকা পালন করছে। কি নেই বর্তমানে যা প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল নয়? এই প্রযুক্তির কল্যাণেই মূলত পৃথিবীর গতি দিনকে দিন বেড়েই চলছে এবং এই মানুষ আধুনিক প্রযুক্তির  দ্বারা আরও বেশি একাগ্রচিত্তে আবিষ্ট হয়ে উঠছে। স্রেফ অনুভূতির জন্য কল্পনা করুন যে, আধুনিক প্রযুক্তি যেহেতু মানুষকে অভ্যস্ত করে ফেলছে এবং আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারাই বিনা মানুষে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে (অসম্ভব কিন্ত নয়/ তবে এখানে স্রেফ কল্পনার কথা বলছি)। তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? একটু ভাববার জন্য বলা মাত্র। ওমনটা হবার নয়। মানুষ এবং মানুষের দ্বারা রাজনীতির মাধ্যমেই পৃথিবী চলছে এবং সে জন্যই বলেছি, আমরা সৌভাগ্যবান। ভবিষ্যতেও তেমনটাই থাকতে হবে এবং থাকবেও।
তবে হ্যা যেভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে, সেটার সাথে মানুষ দ্বারা পরিচালিত রাজনীতির খাপ খাইয়ে চলাটা কোন এক সময়ে বড় রকমের প্রশ্ন হয়ে সামনে উপস্থিত হবে। বর্তমানেও যে হচ্ছে না, তা কিন্ত মোটেও নয়। একটি সাধারণ উদহারণ দেই। এইতো গত কিছুদিন পূর্বেও একটি পুকুর হয়তো দু’তিন শত লোকে সপ্তাহ ধরে কাটতো। বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে একজন মানুষ একটি পুকুর একদিনের কম সময়েও কেটে শেষ করতে পারে। প্রশ্ন হতেই পারে পুকুর কাটার সাথে রাজনীতির কি সম্পর্ক? গভীর সম্পর্ক আছে। সময় ও কর্মসংস্থানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। লক্ষ্য করুন, প্রযুক্তির একটি মেশিন দু’তিন শত জনের কর্মস্থল ফাঁকা করে দিচ্ছে পুকুর কাটার কাজটিকে সহজ ও সুন্দর করে শেষও করে দিচ্ছে। ঠিক সেখানেই গতিময় পৃথিবীর গতি ও প্রযুক্তির সাথে মানুষ দ্বারা পরিচালিত রাজনীতির একটি আধুনিকণের বিরাট প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। কেননা রাজনীতির আধুনিকরণ না হলে বর্তমান গতিশীল পৃথিবীর বুকে একটি রাষ্ট্র আগামীর দীর্ঘদিন টিকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। একটু স্মরণে রাখবেন, আমি কিন্ত অদূর দীর্ঘ ভবিষ্যতের কথা বলছি না। আমি নিকটবর্তী ভবিষ্যতের কথা বলছি কিন্ত। তখন পৃথিবীর বহু রাষ্ট্র বিলিন হবে অথবা অন্তর্ভুক্তি হবে অন্যের সাথে। আমি বেশ অবগত আছি যে, বিষয়টির আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই প্রশ্ন উঠবে আমরা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রাজনীতিকে আধুনিকরণ করছি কি?
এই প্রশ্নের উত্তর মনে হয় দেবার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। তবে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আপাতত প্রশ্নটি না হয় তুলে রাখি। রাষ্ট্র, রাজনীতি, আধুনিকরণ, আধুনিক প্রযুক্তি, গতিময় পৃথিবী, তাল মিলিয়ে সমকালে চলা, এই কথাগুলো তুলে আনার পিছনের উপসর্গটি হলো, আমরা আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও বাস্তবিক অর্থেই কোন কিছুতেই স্থিতিশীল হতে পারিনি বলেই অথচ আমরা অত্র অঞ্চলের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জয়ী হয়ে গড়ে উঠা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির কাছে অনেক অনেক চাওয়া পাওয়ার ছিল, আকাঙ্খা ছিল, হবার সম্ভাবনাও ছিল তবে রাষ্ট্রটির জন্মসূত্র থেকেই একটি অস্বাভাবিক রাজনীতির দ্বারা পরিচালিত হবার কল্যাণেই সেই সকল আশাটা ধামাচাপা পড়ে আছে।  অবশ্যই রাষ্ট্রটি যুদ্ধ শেষে ধ্বংসস্তুপ থেকে অনেক দূর এসেছে তবে এটাও সত্য এত রক্তের রাষ্ট্রের যে গতিতে হবার কথা ছিল সেটা হয়নি এবং আরও বেশি কিছু যা হবার সম্ভাবনা ছিল, সেটাও হয়নি। এর পিছনে সবই রাজনীতি। এটাও সত্য যে, হয়নি বলেই যে হবে না, তা অবশ্যই নয়। তবে এই রাষ্ট্রটির দিকে সর্বশেষ বর্তমান সময়ে গভীর দৃষ্টি ফেললে বহুবিধ কারণে শঙ্কা ও ভয় জড়িয়ে আসে। কেন এই শঙ্কা ও ভয়ে কথা বলছি?
কেননা এইতো মাত্র ছয় মাস পূর্বেই এই রাষ্ট্রে আবার একটি রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান হয়ে গেলো যে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, রাষ্ট্রটি একটি নিয়মতান্ত্রীক রাষ্ট্রের সূত্রে যদি আমরা পরিচালনা করতে পারতাম তাহলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এমন একটি অভ্যুত্থানের প্রয়োজন নিশ্চয়ই হতো না। এটা রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের জনগণের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিবা বলতে পারি?  তারচেয়েও বড় প্রশ্ন এই রাষ্ট্র ৫৩ বছর বয়েসে ইতিমধ্যেই অনেকগুলো অভ্যুত্থানের দেখে ফেলেছে এবং বারবার রাষ্ট্রটিকে রাষ্ট্রের আপন গতিপথে ফিরিয়ে আনতে সাধারণ জনমানুষেরা রক্ত দিয়েছে অতঃপর সেই রক্তের বিনিময়েই রাষ্ট্রটিকে রাজনীতির হাতেই তুলে দিয়েছে। ওই যে বললাম বিশ্ব চলেই রাজনীতির দ্বারা এবং সেটা মানুষের জন্য সৌভাগ্য। সাধারণ মানুষ সেই বিশ্বাসের সাথে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তবে বিশ্বাসঘাতকতা বারবার প্রতিবার এসেছে দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছ থেকেই এবং এটাই আমাদের সর্বোচ্চ দুর্ভাগ্য। এই যে বিশ্বাসঘাতকতার কথা লিখছি, সেখানেই George Orwell এর সেই বিখ্যাত বই “Animall Farm” বিপ্লব- অভ্যুত্থান- সংগ্রাম থেকে শেখার রয়েছে। কোন কিছু শুধু শিক্ষা নিলেই হয় না, প্রয়োগটাই মূল বিষয় এবং বাস্তবিক করতে হয়। লেখার শেষে বলি, এত রক্তের যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন বাংলাদেশ তুমি ‘কাল’ না হয়ে আমাদের জন্য ভোরের সূর্যের ‘সকাল’ হয়ে আসো।
লেখক : বুলবুল তালুকদার ।
সমসমাজ -সম্পাদনা পরিষদের সদস্য।
অষ্ট্রিয়া- লিঞ্জ


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!