সোহেল হাসান গালিব একজন কবি। ২০২৫ এর বই মেলায় উজান প্রকাশনী গালিবের বই প্রকাশ করেছে। ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ রাতে গালিবকে গ্রেফতার করে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়ার খবর প্রথমে সামাজিক মাধ্যমে এবং পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক ভাবে গণমাধ্যমকে বলেছিল “সবই তার নিরাপত্তার স্বার্থে করা হচ্ছে।” গালিবের পরিবার জানিয়েছে, পুলিশ তাকে নিয়ে যাওয়ার পর কিছু সময় যোগাযোগ ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিএক্টিভেট করা এবং মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ ছিল। কবির নিখোঁজ হওয়ার পর সাহিত্য অঙ্গনে অনেকেই তার খোঁজ চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন।
সাহিত্য পত্রিকা ‘লোক’ এর সম্পাদক অনিকেত শামীম ফেসবুকে লেখেন, “গালিবের জীবন আজ বিপন্ন। তাকে রক্ষায় সচেতন লেখক-শিল্পীদের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, “একটি কবিতার কারণে গালিবের জীবন বিপন্ন, কিছু উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে।” ২০২৪ সালে গালিবের একটি কবিতাকে কেন্দ্র করে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় এবং তার বিরুদ্ধে ‘নবীকে কটাক্ষ’ করার অভিযোগ ওঠে। এই কবিতাটি ‘উজান’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। নিরাপত্তার কারণে উজান প্রকাশনী তাদের স্টল বন্ধ রেখেছে। শুক্রবার, বইমেলায় স্টলটি ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হহয়েছিল । উজান প্রকাশক ষড়ৈশ্বর্য মুহাম্মদ গণমাধ্যমকে জানান, “নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে আমরা স্টল বন্ধ রেখেছি।” বইমেলা টাস্কফোর্স উপকমিটির আহ্বায়ক সেলিম রেজা জানান, “বইমেলা পরিচালনা কমিটি থেকে কোনো স্টল বন্ধ করা হয়নি। প্রকাশকই তার স্টল বন্ধ রেখেছেন।” সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সূত্রে দাবি করা হচ্ছে, কবি গালিবকে নিরাপদ হেফাজতে রাখা হয়েছে, তবে নিরাপত্তা হেফাজত আর গ্রেফতার একে অপরের সমার্থক। যদি কবি গালিবকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়ে থাকে, তবে তা হামলাকারীদের অপকর্মকে উৎসাহিত করার মতো হবে। শেখ হাসিনার আমলেও ‘ধর্মীয় অনুভূতি’তে আঘাতের অভিযোগে ভিন্ন মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হানা হচ্ছে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশরা তৈরি করে, যা মূলত তাদের ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখতে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই ধারায় পুলিশকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যেকোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেয়া হয়, যা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার পরিপন্থী। পাকিস্তান আমলেও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ৫৪ ধারার অপব্যবহার ও সংবিধানবিরোধী বলে রায় দিয়েছে, এবং গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের প্রয়োজনীয়তা জানিয়েছে। এছাড়া, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ১৬৭ ধারায় যে কোন স্বীকারোক্তি আদায়েও অবিচার এবং শোষণ চলছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি এসব আইনের সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করলে প্রমাণ বা অভিযোগ ছাড়া ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, যা সংবিধানের বিরোধী।পুলিশ ৫৪ ধারায় গালিবের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে, যা একটি নিবর্তনমূলক আইন। ব্রিটিশ আমল থেকে এই আইনটি চলে আসছে এবং রাজনৈতিক কর্মীদের হেনস্তা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। সোহেল হাসান গালিবের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেছিলেন, তবে আদালত উভয় আবেদনই নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছে এবং তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে।
৫৪ ধারার আওতায় গালিবের বিরুদ্ধে ‘ইসলামের নবীকে অবমাননা’ করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলেও, এটি একটি গ্রেফতার দেখানো প্রক্রিয়া মাত্র, যার ফলে ‘অবমাননার’ অভিযোগ প্রমাণের কোনো সুযোগ নেই। গালিবের কবিতাটি বইয়ে প্রকাশিত, যা থেকে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? ৫৪ ধারা পুলিশের ক্ষমতাকে অতিরিক্ত শক্তিশালী করেছে, যার ফলে অনেক সময় বৈধ প্রমাণ ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়, এবং মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। বিশ্বের উন্নত দেশে, ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা হয় না, কিন্তু আমাদের দেশে ৫৪ ধারার কারণে পুলিশ প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার করে।