বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৬ অপরাহ্ন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের শাস্তির বাড়াবাড়ি

সমসমাজ ডেস্ক
বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি কয়েকজন ছাত্রীকে দেওয়া শাস্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ তকমা দেওয়ার ঘটনা, এবং একের পর এক কঠোর শাস্তির ফলে তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত সংশোধন, তবে গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ না হলে এমন শাস্তি দেওয়া উচিত নয়, যা তাদের জীবন ধ্বংস করে দেয়। ঘটনা শুরু হয় ৪ ফেব্রুয়ারি, যখন ছাত্রদের একটি দল ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হল’ এর সামনে নৌকা আদলে তৈরি বসার স্থানটি ভাঙতে যায়। তাদের দাবি ছিল, ক্যাম্পাসে পতিত আওয়ামী লীগের কোনো চিহ্ন রাখা যাবে না। তবে হলের ছাত্রীদের দাবি ছিল, প্রশাসনই এটি ভাঙুক এবং সেখানে বিকল্প বসার স্থান তৈরি করুক। ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ছাত্ররা আবারো ওই স্থাপনাটি ভাঙতে যায়, এবং তখন ছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্রদের তর্কাতর্কি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, প্রক্টরিয়াল টিমকে একাধিকবার ফোন করার পরও তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়নি, যার ফলে তারা ভিসির বাসভবনের দিকে রওনা দেন প্রতিবাদ জানাতে। এরপর, প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এবং গালিগালাজের ঘটনা ঘটে। এই সময় প্রক্টরিয়াল টিমের একজন শিক্ষক উত্তেজিত হয়ে ছাত্রীদের ‘ফ্যাসিবাদের দালাল’, ‘হাসিনার লোক’ ইত্যাদি তকমা দেন। এর পরেই এক ছাত্রী ওই শিক্ষকের গায়ে হাত তোলেন, এবং পরবর্তীতে ছাত্রীরা বহিষ্কারের শাস্তি পায়—এক ছাত্রীকে আজীবন এবং ৯ জনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। অভিযুক্ত ছাত্রীদের দাবি, অনেকেই বুঝতেই পারেননি যে প্রক্টরিয়াল টিম ঘটনাস্থলে ছিল। বাগ্‌বিতণ্ডা এবং হাতাহাতির মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এই ভুলটি ঘটে। ওই শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার পর, ছাত্রীটি চরম ভীত হয়ে পড়েন এবং তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে, হল কর্তৃপক্ষের কয়েকজন শিক্ষক তাকে সহযোগিতা করেননি।

এ ঘটনার পর, কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, রাত ৯টায় যখন ছাত্রী হল বন্ধ হয়ে যায়, তখন ছাত্ররা কীভাবে মধ্যরাতে সেখানে ঢুকে স্থাপনাটি ভাঙার চেষ্টা করেছিল? আর, যদি ছাত্রীদের প্রতিবাদকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পতিত সরকারের নামে থাকা স্থাপনাগুলোর নাম পরিবর্তন করেনি, যেখানে এমন প্রতীক তারা আর রাখতে চাননি? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ উঠেছে যে, তারা সাংবাদিকদের ভিডিও করতে বাধা দিয়েছে এবং তাদেরও অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে। ছাত্রীদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, সাংবাদিকরা তাদের পরিচয়পত্র ছাড়াই ভিডিও করছিলেন, যার ফলে তারা তাঁদের আসল পরিচয় বুঝতে পারেননি। এছাড়া, ঘটনাটি রাতে ঘটার কারণে অনেক ছাত্রী রাতের পোশাকে ছিলেন, যেটি তারা জানতেন না যে তাদের ভিডিও করা হবে।

এ ঘটনায় ছাত্রীরা কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশও পাননি, এমনকি এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও তাদের শাস্তি সম্পর্কে কোনো চিঠি তাদের কাছে পৌঁছায়নি। যখন প্রতিবাদী ছাত্ররা এই অন্যায্য শাস্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন, তখন প্রক্টর ফেসবুকে লেখেন, “বিপ্লবীরা কি হানি ট্র্যাপে,” যার মানে দাঁড়ায় ছাত্রীরা তাদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদী ছাত্রদের কথা বলাতে বাধ্য করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে তারা আগেও নারীদের সম্পর্কে অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন। যৌন হয়রানিমূলক বক্তব্য দেওয়া কোনো ব্যক্তির বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া, ক্যাম্পাসের কিছু সাংবাদিকও ওই ছাত্রীদের বিরুদ্ধে বাজে ভাষায় মন্তব্য করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তে অনেক শিক্ষকও সমালোচনা করেছেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইদুল ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, “যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা অনেকেই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির যোদ্ধা। প্রশাসনকে বলি, আপনি যে চেয়ারে বসে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করার ক্ষমতা দেখাচ্ছেন, তা এই শিক্ষার্থীদের রক্ত দিয়ে অর্জিত, এবং প্রশাসনের বহু কর্মকাণ্ডের মধ্যে তাজা রক্তের দাগ এখনও স্পষ্ট রয়েছে।” এ ঘটনায়, দেশের ১৫৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক—যাদের মধ্যে শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক, কবি এবং চলচ্চিত্রকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন—বিবৃতি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, প্রশাসন ঘটনাটি তদন্ত না করে একযোগে শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, ঘটনার পুনঃতদন্ত এবং প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ ঘটনাটি নিয়ে ক্যাম্পাসে একাধিক বিক্ষোভ, মানববন্ধন এবং ঢাকায় প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। এখন অপেক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা আরও একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তির উদ্দেশ্য কি শিক্ষার্থীদের সংশোধন, নাকি ক্ষমতার প্রদর্শন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন সিদ্ধান্ত শিক্ষার পরিবেশ এবং ছাত্রদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, এবং যদি এ ধরনের সিদ্ধান্তে অবিচার হয়, তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!