প্রতুল মুখোপাধ্যায়, যিনি ১৯৪২ সালে বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন, ছিলেন একজন অসামান্য সঙ্গীতশিল্পী এবং গণমানুষের শিল্পী। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক, এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। তার সঙ্গীত জীবন ছিল একেবারে সাধারণ এবং অনাড়ম্বর। তিনি কোনো প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তবে তার জন্মগত সঙ্গীত প্রতিভা তাকে বাংলা সঙ্গীতের জগতে এক বিশেষ অবস্থানে পৌঁছতে সহায়তা করে। পেশাগত জীবনে তিনি ব্যাংকে চাকরি করতেন, কিন্তু তার চিন্তা-ধারা এবং রাজনৈতিক আদর্শ ছিল বামপন্থী ঘরনার। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন তিনি কখনোই বামপন্থী নেতাদের ঘনিষ্ঠজন হননি। বরং, তাকে প্রায়ই দেখা যেত নকশালপন্থীদের জনসভা ও পথসভায় গান গাইতে। এই সময়েই তিনি পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কৃষক আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং মমতা ব্যানার্জীর কাছাকাছি চলে আসেন।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান এবং সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য ছিল অত্যন্ত সহজ এবং সরল। তিনি খুব কমই যন্ত্র ব্যবহার করতেন তার গানে। তার পরিবেশনা ছিল সম্পূর্ণ এক ধরণের প্রকৃত এবং সাদামাটা। গানের মধ্যে তালি বা তুড়ির ব্যবহার ছিল তার স্বাক্ষর। তার গানের মূলধারা ছিল মানুষের সংগ্রাম, সমাজের অস্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাহিনি। তবে তার সবচেয়ে পরিচিত এবং কালজয়ী গানটি ছিল “আমি বাংলায় গান গাই”, যা তিনি বাংলা ১৪০০ সালের পয়লা বৈশাখে নিজের বাড়িতে বসে লিখেছিলেন এবং সুর দিয়েছিলেন। এক বছর পর, ১৯৯০ সালে ‘যেতে হবে’ অ্যালবামে গানটি প্রকাশিত হলে তা তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এই গানটি ছিল তার সঙ্গীত জীবনের মাইলফলক। এরপর “ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে”, “নিকোসে সিকেলে আফ্রিকা”, “ছোকরা চাঁদ–জওয়ান চাঁদ” এর মতো গানগুলোও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতে থাকে এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে কবীর সুমন একসময় লিখেছিলেন, “লোকটা নিজেই একটা গান, আস্ত একটা গান,” যা তার সঙ্গীত জীবনের অপরিহার্যতা এবং সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর নিষ্ঠা ও প্রেমকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তার গানগুলো ছিল সঙ্গীতের অতিরিক্ত কিছু—এসব গান ছিল মানুষের জীবন, সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে গভীর প্রতিফলন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের প্রতিটি সুর, কথা এবং অনুভূতি ছিল মানুষকে সচেতন করতে এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। তার সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি বাংলা গানের এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন, এবং তাকে বাংলা গানের এক অগ্রণী শিল্পী হিসেবে স্থায়ীভাবে স্মরণ করা হবে।