জুলাই-অগাস্ট ২৪ আন্দোলনের সময় সরকারি হিসেবে এক হাজারের কম মানুষ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে খুন হন। তবে ঠিক কতজন হত্যার শিকার হয়েছেন তা নিয়ে সরকার এবং জাতিসংঘের রিপোর্টে তফাৎ রয়েছে। এই হত্যাগুলোর বিচার এবং পুলিশ-ৱ্যাব সহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার ব্যবস্থা এর জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি দীর্ঘকালীন। ইতিমধ্যে ইউনুস সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা ও সেনা প্রধান ওয়াকার-উজ-জামানপ্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে নিশ্চিত করছে ৱ্যাব বিলুপ্ত হচ্ছে না। ইতিমধ্যে ৱ্যাবের পোশাক বদলের ফরমান জারি হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে উপরি কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন এনে এই বাহিনীকে আগের মতই রেখে দেওয়া হবে। ইউনুস সরকার জুলাই-অগাস্ট ২৪ আন্দোলনের সময় খুনের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে মনোনীত করছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর সাথে কোন আন্তর্জাতিক আইন – আদালত বা অন্য দেশ জড়িত নয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, পূর্বনির্ধারিত বিষয়ে শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন অফিসের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলেন।
তাজুল ইসলাম গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, “আমরা রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে চিকিৎসাধীন আহত রোগী এবং তাদের স্বজনদের কাছে শুনেছি, শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’। অর্থাৎ কর্তব্যরত চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আহতদের কোনো চিকিৎসা না দিতে এবং কাউকে হাসপাতাল থেকে যেতে না দিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।” চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, “রোগীদের পাশাপাশি, এই নির্দেশনার কথা সেখানকার ডাক্তাররাও আমাদের জানিয়েছেন। এ ধরনের তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে, এবং আমরা সেগুলো আদালতে উপস্থাপন করেছি।” তাজুল ইসলামের ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ বক্তব্য এমন সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের রাজনীতি শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার কথা ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
জুলাই-অগাস্ট ২৪ এর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন এবং হত্যার বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে তাজুল ইসলামের ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ ব্যাখ্যা প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণত ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ দ্বারা বোঝানো হয়, কোনো ব্যক্তি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে, চিকিৎসা না হওয়া পর্যন্ত তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে না। শেখ হাসিনা নো ট্রিটমেন্ট , নো রিলিজ এই জাতীয় কিছু বলেছিলেন কিনা তা জানার কোন উপায় নেই। কারণ এই বক্তব্য এইবার প্রথম আলোর মুখ দেখছে। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল মানুষের মুখ থেকে এই বক্তব্য এসেছে। আমরা ধরে নিতে পারি শেখ হাসিনা এই কথা বলেছেন। শেখ হাসিনার বলা, না বলার মধ্যে এই বক্তব্য সীমাবদ্ধ নেই। এই বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ মূল আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
২৭ জুলাই ২০২৪ সালের দৈনিক যুগান্তর, প্রথম আলো ও কালের কণ্ঠের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় আহতদের দেখতে শেখ হাসিনা পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শন করেছিলেন । পরিদর্শনকালে শেখ হাসিনা গুরুতর আহত কয়েকজনের সাথে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সকল ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। শেখ হাসিনার পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, কিন্তু কোন গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার চিকিৎসা বন্ধের নির্দেশের কথা বলা হয়নি। শেখ হাসিনার পঙ্গু হাসপাতাল পরিদর্শনের সংবাদ প্রধান টিভি চ্যানেলগুলিতে সরাসরি প্রচারিত হয়েছিল । এই সব সরাসরি সম্প্রচারে চিকিৎসা বন্ধের কোনও সংবাদ পরিবেশিত হয়নি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ এর অর্থ দাঁড় করিয়েছেন চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশ। তাজুল ইসলামের ‘No treatment, No release’ এর বাংলা ব্যাখ্যা সঠিক নয় । তাজুল ইসলাম ইংরেজি বাক্য / ফ্রেজের প্রচলিত অর্থ থেকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন । ইংরেজি ভাষার ‘No treatment, No release’ এবং এই জাতীয় বেশ কিছু অভিব্যাক্তি / ফ্রেজ রয়েছে। যেমন ‘No Mask, No Service’, ‘No ID, No Entry’, ‘No hat, no play’। তাজুল ইসলামের “no treatment, no release” এর অনুবাদ রীতি গ্রহণ করলে বহুল ব্যাবহৃত ইংরেজি ফ্রেজ গুলোর অর্থ বদলে যাবে। যা প্রচলিত ইংরেজি অর্থের সাথে মিলবে না, লেজে গোবরে অর্থ দাঁড়িয়ে যাবে !
নো ট্রিটমেন্ট , নো রিলিজ শুধু ভুল ভাবে অনূদিত হয়নি। এই জাতীয় বক্তব্য কিছু আইনগত প্রশ্ন সামনে এনেছে। তাজুল ইসলামের বক্তব্যে আরেকটি নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, হাসপাতালের ডাক্তার এবং রোগীরা তাকে জানিয়েছেন শেখ হাসিনার চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়ের নির্দেশ। তাজুল ইসলাম প্রসিকিউটর। সহজ বাংলায় সরকারি উকিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সরকার মামলা করেছে। এই মামলায় প্রসিকিউটর / সরকারি উকিল একদিকে থাকবে। অন্যদিকে থাকবে হাসিনার উকিল। সরকারি উকিলের তদন্ত বা তথ্য সংগ্রহের কোন আইন বা আইনি রেওয়াজ নেই। তাজুল ইসলাম যা করেছেন বলে গণমাধ্যমকে তা তদন্তকারী অফিসারের দায়িত্ব, যাকোন ভাবেই প্রসিকিউটরের দায়িত্ব নয়। যদি প্রসিকিউটর তদন্তকারী অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন বা তার সাথে আলোচনা করেন, তবে তা তদন্তের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করবে। যে কোন বিষয়ের নিরেপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠ বিচার সবার কাম্য। সুষ্ঠ বিচারের স্বার্থে ভুল অনুবাদ বা আইনি সীমানার বাইরে গিয়ে কিছু বলা বিচারের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করবে।
নো ট্রিটমেন্ট , নো রিলিজ শুধু ভুল ভাবে অনূদিত হয়নি। এই বক্তব্য কিছু আইনগত প্রশ্ন সামনে এনেছে। তাজুল ইসলামের বক্তব্যে আরেকটি নতুন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। তিনি দাবি করেছেন, হাসপাতালের ডাক্তার এবং রোগীরা তাকে জানিয়েছেন শেখ হাসিনার চিকিৎসা না দেওয়ার বিষয়ে। তবে এটি তদন্তকারীর দায়িত্ব, যা সাধারণত প্রসিকিউটরের নয়। যদি প্রসিকিউটর তদন্তকারী অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন বা তার সাথে আলোচনা করেন, তবে তা তদন্তের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
সহায়ক তথ্য সূত্র:
১. প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর -হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে ‘নো ট্রিটমেন্ট, নো রিলিজ’ নির্দেশ দেন হাসিনা। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। যুগান্তর।
২. পঙ্গু হাসপাতলে গেলেন প্রধানমন্ত্রী , আহতদের চিকিৎসার আশ্বাস। ২৭ জুলাই ২০২৪। প্রথম আলো।
৩. এবার আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতাল গেলেন প্রধানমন্ত্রী। ২৭ জুলাই ২০২৪। কালের কণ্ঠ।
৪. সহিংসতায় আহতদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে প্রধানমন্ত্রী। ২৭ জুলাই ২০২৪। যুগান্তর।