বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৩৯ অপরাহ্ন

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি একজন প্রবাসীর খোলা চিঠি :

ইমাম হোসাইন
রবিবার, ২ মার্চ, ২০২৫

ড. মুহাম্মদ ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা –
বাংলাদেশ সরকার

যখন আপনার নোবেল পাওয়ার গল্প পড়লাম হুমায়ূন আহমেদের বর্ণনায়। তাঁর লাস্যময়ী বর্ণনায় আমাদের ভিতরে গর্বের তরঙ্গ উঠেছিল । অনুভব করলাম নোবেল শুধুমাত্র মুহাম্মদ ইউনূস পান নি, এটি আমি পেয়েছি, আমরা পেয়েছি, বাংলাদেশ পেয়েছে। জানেন আপনার নোবেল পাওয়ার পর বাঙালির বাধ-ভাঙা উচ্ছ্বাস সম্পর্কে? অনুভব করেছিলেন কখনো, একজন বাঙালি যখন বলেছিল, ‘আমরা নোবেল পেয়েছি’, কতটা শ্লাঘনীয়, কতটা মধুর, কতটা হৃদয়-শীতলকারী এই বাক্য? এবং আপনি জানেন কি, আপনার নিন্দুকের সাথে কতটা বাক্যযুদ্ধ করতে হতো; কতটা আস্ফালন সহ্য করতে হতো? একমাত্র নিঃস্বার্থ, নির্ঝঞ্ঝাট এবং উদার মানুষেরাই আপনার অর্জনে খুশি হয়েছিল, গর্বিত হয়েছিল, এবং তারা আপনার হয়ে তর্কযুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিল। যারা কিছুমাত্রই আপনাকে সহ্য করতে পারত না, যাদের প্রকাশ্য প্রমাণ রয়েছে, আপনার বিরুদ্ধে আস্ফালনের, মিথ্যাচারের, তারাই আজ আপনার দরদী, আপনার গ্লোবালাইজেশনের দরদী, আপনার অর্জনের গুণী-দরদী। আর আমরা আপনার শত্রু।

জনাব ইউনূস, গত জুলাইয়ে আমি বরাবরই ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের সমর্থনে ছিলাম, এবং তাদের সাবধান থাকতে বলেছিলাম। গত ১৩-ই জুলাই, দেশ স্বাভাবিক। শুধুমাত্র ঢাকায় দেশের নাড়ি-ভুড়ি ছিড়ে যাওয়ার লক্ষণ, আমি বিজ্ঞ চিকিৎসকের ন্যায় তা টের পাই। সেইদিন আমি আপনার মতো এমন একজনের, অবশ্যই নোবেলজয়ী নয়, সাথে চিঠিতে দেশের ভবিষ্যত-সম্পর্কে আলোচনা করি। কিন্তু আমি বরাবরই টের পেয়েছিলাম ছাত্ররা ব্যবহৃত হচ্ছে, তাই তাদের বুঝেশুনে পদক্ষেপ নিতে বলি। জনাব ইউনূস আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি-না, এই কয়মাসে অসংখ্য, অগণিত বিপ্লবী ছাত্ররা পশ্চাত্তাপ করেছে, করছে। শুধুমাত্র যারা রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিপ্লব করেছিল, তাদের কোনো নড়াচড়া নেই, এবং তারা দেশের বিশৃঙ্খলা, অবিচার ইত্যাকার নিত্য ঘটা সমস্যাগুলোও দেখছে না। যদিও এ নতুন কিছু নয়— আওয়ামী আমলেও আমরা এমন দৃশ্য দেখেছি। তাদের কাছেও দেশ ছিল স্বর্গীয় উদ্যান। সেই দৃশ্য পালটে দিয়ে নতুন দৃশ্য আনতে গিয়ে, অনাহুত দৃশ্য ঘটে গিয়েছে; পুরো দেশে দৃশ্যায়িত হচ্ছে এখন বৈসাদৃশ্যের দৃশ্য। মুহাম্মদ ইউনূস এগুলো কি আপনার দৃষ্টিগোচর হয়?
জনাব ইউনূস— পাঁচ আগস্টের পর টালমাটাল এই দেশ দেখে ভড়কে গিয়েছিলাম। চারিদিকে ভাঙচুর, হরিরলুট, মারামারি, প্রতিহিংসা দেখে বেজায় বিষণ্ণ ছিলাম। যখন আপনি এলেন এই দেশে, বা আপনাকে আনা হলো, যাবতীয় বিষণ্নতা ঝেড়ে ফেলে মন নাচতে শুরু করল। কেননা ছাত্ররা যতই বলাবলি করুক, ‘হাসিনার বিকল্প আমি, আপনি, আমরা সবাই’, তাদের এ-কথায় বিশ্বাস করা কষ্টের ছিল। হলোও তাই, বিশ্বাসে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল জনগণের— তবুও বিপ্লবের রিয়েকশন বলে মনকে বুঝাতে হলো; কিন্তু মন তো শাস্ত্রের যুক্তি মানে না।
মুহাম্মদ ইউনূস, আমরা আপনাকে দেখে একরকম গদগদ হয়েই অন্তরবর্তী সরকারের প্রস্তাবে রাজি হই। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা লজ্জা, কিছুটা জড়তা নিয়ে ছাত্রদের ধন্যবাদ দেই, যাইহোক এরা কাজের কাজ করেছে। নোবেল লরিয়েট হবেন আমাদের দেশের নেতা। যা আমাদের সৌভাগ্য, পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রপ্রধান নোবেলজয়ী? হাং সাং সূচীর কথা জানি। কিন্তু আমাকে উদাহরণ খোঁজতে বাইরে যেতে হবে না। আমার দেশের প্রধানই নোবেলজয়ী। বিরাট গর্বের ব্যাপার।

কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মুহাম্মদ ইউনূস, আপনি আর আমাদের গর্বের কারণ থাকতে পারেন নি। থাকতে পারেন নি আপনার জন হয়ে, থাকতে পারেন নি নমস্য হয়ে। মুহাম্মদ ইউনূস, হাসিনার সরকার আপনার সাথে যে অমানবিক আচরণ করেছিল, তার অল্পবিস্তর আমরা জানি। আমাদের মনে দাগ কেটেছিল আপনার সাথে হওয়া অন্যায় দেখে। আপনি যে সহানুভূতি কুড়িয়েছিলেন, হৃদয়মন্দিরে আপনি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বেদী নির্মাণ করেছিলেন, আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, তা আর নেই। মাত্র কিছু দিনেই আপনি এত বিরক্তভাজন, উপহাসযোগ্য ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হবেন তা অকল্পনীয় ছিল। পৃথিবীতে একমাত্র আপনিই বোধহয়, যে নোবেলের মতো শ্রেষ্ঠ সম্মানের মুকুটদারী অথচ হাস্যকর, বিদ্রুপের উৎকৃষ্ট নমুনা।

জনাব ইউনূস, আপনার শাসন ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং মানবেতর। আপনার শাসনে নজিরবিহীন অবিচারের সংস্কৃতি দেখেছে জাতি, আপনার শাসনে অতুলনীয় উগ্রতা দেখেছে বিশ্ব, আপনার শাসনে অকল্পনীয় প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখেছে পৃথিবী, আপনার শাসনে বচনাতীত ঘৃণার দর্শন দেখেছে আকাশ-বাতাস। আপনি ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ ঠেকাতে ব্যর্থ, আপনি নির্বিচারে খুন ঠেকাতে ব্যর্থ, আপনি সংখ্যালঘু নির্যাতন রোধে ব্যর্থ, আপনি বাকস্বাধীনতা রক্ষায় ব্যর্থ, আপনি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকাতে ব্যর্থ, আপনি লুটপাট, সিন্ডিকেট এবং দেশের টাকা পাচার রোধে ব্যর্থ— আপনি শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন, শিশু বাচ্চাদের বুকেই আপনি জায়গা করতে পারেন নি, আপনি একটা মানসিক বন্ধ্যা জাতির রূপকার; আপনি বাংলা, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্যকে চর্যাপদের যুগে নিয়ে গিয়েছেন, সবশেষে আপনার কোনো কার্যকলাপেই জনগণ সন্তুষ্ট নয়। আপনি কাকে কোথায় নিয়োগ দিচ্ছেন, জনগণ জানে না। কাকে কেন ছাটাই করছেন জনগণ জানে না। আপনি মীমাংসিত সকল বিষয়ে হাত দিয়ে জনমনে সৃষ্টি করেছেন বিতর্ক। আপনি স্বাধীনতা দিবস বাতিল করেছেন, আপনি ১৫-ই আগস্ট শোক দিবস বাতিল করেছেন, আপনি ১৬-ই ডিসেম্বর বিজয়ী কুচকাওয়াজ বন্ধ করেছেন, আপনি স্বাধীনতার মাসকে নিস্তব্ধ, বিরানভূমিতে রূপান্তর করেছেন। আপনার দ্বারা ৩২ নম্বর সংস্কার হয় নি। তা পুড়িয়ে দেওয়া দুর্বৃত্তদের বিচার হয় নি। আপনার দ্বারা সংস্কারের নামে অনাসৃষ্টিই হয়েছেই শুধু। অথচ এই সুযোগ ছিল আপনার, এই সুযোগ ছিল ইতিহাসে পদচিহ্ন আঁকার, এই সুযোগ ছিল বাংলাদেশকে অনন্যতা পাইয়ে দেবার। কিন্তু আপনি তা করেন নি, আপনি মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকারকারীদের লাই দিচ্ছেন, মুক্তিযোদ্ধার গলায় মালা পরানো রাজাকার শাবকদের বৈধতা দিয়েছেন, অথচ আপনি মুক্তিযোদ্ধা। কীভাবে পারলেন এমনটা করতে?

জনাব ইউনূস, হাসিনার আমলে, বা তার আগেও আমরা দেখেছি, শুনেছি, রাজনীতিক বৈরিতা ছিল। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে হেনস্তা করেছে, নির্যাতন, নিপিড়ন করেছে। কিন্তু আপনার আমল অভাবিত; আপনার আমলে সাধারন মানুষের জীবনে আতংক, জনমনে সর্বদা ভীতি। পবিত্র মবজাস্টিস এতই শক্তিশালী হয়েছে আপনার আমলে— দুটো কথা কয়ে সুখ নেই, আপনার অনুভূতি এতই প্রখর, সাইবার বুলিং অপরাধ হয়ে যায়। হাসিনার আমলে এমন সিস্টেম ছিল, হাসিনা সাধারণ মানুষের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করত, তবু ভালো মন্দ দুটো কথা বলা যেত। আপনাকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখতেও সাহস পাচ্ছে না, পাছে আপনার বাহিনী তাকে বন্দী করে। এরশাদের আমলে মানুষ প্রাণভরে তাঁর সমালোচনা করেছিল, সেঁ কিন্তু কারো মুখ চেঁপে ধরে নি। তাঁকে লোকে স্বৈরাচার বলত, একবার ভাবুন, স্বৈরাচারের আমলেই মানুষ নির্লিপ্তভাবে তাঁকে স্বৈরাচার বলত, আমি বলব, তাঁর মতো ভালো শাসক হওয়া আপনার জন্য দূরুহ।

জনাব ইউনূস— অনেক কথাই বললাম, গোস্বা করবেন না আশাকরি। এবার একটা পরামর্শ দেই, আমি একজন নাগরিক, একজন জনগণ হিসেবে, জনগণের মনের কথাই বলছি, আমরা আসলেই বিরক্ত। আপনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দিন, পারলে এই জুন মাসেই দিন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি আপনার কাজে ফিরে যান। জনগণ আপনাকে মনে রাখবে। যদি আরও সময় নেন, আরও দেরি করেন, আপনার নামের পাশে হাসিনার বিশেষণ বসে যাবে। আপনি অবাঞ্ছিত ঘোষিত হবেন; সম্মানের মুকুট যাবে আস্তাকুঁড়ে।
জনাব ইউনূস— আমরা যারা আপনাকে নিয়ে গর্ব করতাম, নোবেল নিয়ে শ্লাঘা বোধ করতাম, ঘুরেফিরে আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদেরই মনে। আপনি তো জানেন আপনাকে কারা অপছন্দ করত; এখন তারা আপনার আশেপাশে আছে, আপনি একদিন দারুণ পশ্চাত্তাপ করবেন, করুণ উপলব্ধি হবে আপনার। আমরা চাই না, এমন দুঃখের দিন আপনার জীবনে আসুক। ইতিহাসের অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারি, একজন লেখক যখন রাষ্ট্রপ্রধানকে উদ্দেশ্য করে কলম ধরে, চিঠি লিখে, রাষ্ট্রপ্রধানের অবস্থা তখন সুবিধাজনক থাকে না। আমি চাই আমার চেয়ে বড়ো, এবং প্রকৃত অর্থেই শক্তিশালী লেখক আপনাকে চিঠি না লিখুক, তাই আমি আপনার বড়ত্ব, আমার তুচ্ছতার ব্যবধান ভুলে গিয়ে আপনাকে লিখতে বসেছি। দিনশেষে আপনিই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের গর্বের কারণ।

জনাব ইউনূস, আইন শৃঙ্খলা বাহীনির চরম অবনতি কারণে মানুষ নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে। আপনার সরকারের এদিকে নজর রাখা উচিত।

সর্বোপরি আপনার সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ভালো থাকবেন।
.
ধন্যবাদান্তে
ইমাম হোসাইন
ইউনাইটেড কিংডম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!