২০২৫ সালের ৪ মার্চ, মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকার গুলশান এলাকায় একদল ছাত্র-জনতা সাবেক সংসদ সদস্য তানভীর ইমামের বাসায় তল্লাশি চালায়। তাদের দাবি ছিল, বাড়িটিতে অবৈধ অস্ত্র এবং হত্যাকারী ছাত্র-জনতা লুকিয়ে রয়েছে। ঘটনাটি রাত সাড়ে ১১টার দিকে শুরু হয়, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, ছাত্র-জনতা তানভীর ইমামের বাসায় অভিযান চালাবে। এর পর গুলশান ২-এর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পার্কের সামনে শতাধিক মানুষ জড়ো হয়ে রাত ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যান। বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডরা তাদের বাধা দিলেও কিছু শিক্ষার্থী গেট টপকে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন। পরে গেট খুলে দিলে শতাধিক ছাত্র-জনতা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এবং তল্লাশি শুরু করেন। তারা ফ্ল্যাটের প্রতিটি কক্ষ, লাগেজ, ড্রয়ার ও সিন্দুক তল্লাশি করেন। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মো. আব্দুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেন, “লোকজন হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল এবং বাড়ি তছনছ হয়ে গেছে।” গুলশান থানা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে যে, ৮ মার্চ মধ্যরাতের ঘটনার একদিন আগে, ৩ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে, একই অজুহাতে কিছু লোক বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। তবে পুলিশ এসে তাদের বাধা দেয়।
মঙ্গলবার যে বাড়িটি এইচ টি ইমামের বাড়ি নয় বলেই দাবি করেছেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ও গাড়িচালক মো. আব্দুল মান্নান। তিনি বলেন, ‘এটি এইচ টি ইমামের বাড়ি নয়, এটা রহমান সাহেবের বাড়ি। রহমান সাহেবের মেয়ের সঙ্গে তানভীর ইমামের বিয়ে হয়েছিল অনেক আগে। ২০০১ সালের দিকে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। রহমান সাহেব ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। তার মেয়ে এই বাড়িতে থাকেন।’ তানভীর ইমাম, প্রয়াত এইচ টি ইমামের ছেলে, সিরাজগঞ্জ ৪ (উল্লাপাড়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে দশম ও একাদশ সংসদে এমপি নির্বাচিত হন। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পাননি। তিনি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে এবং দুদক তদন্ত শুরু করে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে, দুদকের আবেদনে আদালত তানভীর এবং তার স্ত্রীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ঘটনার প্রায় আধঘণ্টা পর গুলশান থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পুলিশ কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, “এটি তানভীর ইমামের সাবেক স্ত্রীর বাড়ি, তাদের মধ্যে ২০-২২ বছর আগে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।” অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আল আমিন হোসাইন জানান, “ছাত্র-জনতা অভিযোগ করেছিল, বাড়িতে অস্ত্র ও টাকা মজুদ রয়েছে, কিন্তু তল্লাশিতে কিছুই পাওয়া যায়নি।” প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, শাকিল আহমেদ, যিনি একসময় ওই বাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন, ২০-২৫ জন লোক নিয়ে বাসায় ঢুকে তল্লাশির অজুহাতে ভাঙচুর ও লুটপাট করেন। ঘটনাস্থলে রাত সাড়ে ১২টার দিকে গুলশান থানার পুলিশ, উপকমিশনার ও সেনাবাহিনী উপস্থিত হয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শাকিল আহমেদ (২৮), জুয়েল খন্দকার (৪৮) এবং তার ছেলে শাকিল খন্দকার (২৪) রয়েছেন।
তানভীর ইমাম বা আওয়ামী লীগসহ যে কোনো দলের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার প্রত্যাশিত। তবে, মধ্যরাতে ঘটে যাওয়া হামলার সাথে নিয়মতান্ত্রিক বিচার ও তদন্তের কোন সম্পর্ক নেই । রাত ১১ টায় ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করার পর, রাত ১২টার দিকে হামলা শুরু হয় এবং ঘটনাটি ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। ঘটনার সময় সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ কেন প্রাথমিক পদক্ষেপ নিয়ে লুটপাট বন্ধ করতে এগিয়ে আসেনি? সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রেসনোটে বলা হয়, গুলশানের ওই বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ, অস্ত্র এবং আওয়ামী লীগের দোসরদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে, এমন তথ্যে ভিত্তিতে মধ্যরাতে ‘তল্লাশি’র নামে ২০ থেকে ২৫ জন লোক দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে পড়ে এবং মালামাল তছনছ, ভাঙচুর ও লুটপাটের চেষ্টা করে। তবে, গণমাধ্যমে উল্লিখিত ঘটনা অনুযায়ী প্রায় ২০০ জন লোক অংশগ্রহণ করেছিল। সরকার পক্ষের প্রেস উইং ২০-২৫ জনের অংশগ্রহণের কথা বলছে। এমন একটি বাস্তবতা, যেখানে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা ঘটনার সাথে যুক্ত অপরাধীদের রক্ষা করার একটি চেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।