শুক্রবার ,৭ মার্চ ২০২৫। নিষিদ্ব ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর পূর্ব ঘোষিত ‘ মার্চ ফর খিলাফত’ কর্মসূচি পালন করে। ৭ মার্চের সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই ঢাকার দেওয়ালে হিযবুত তাহিরীর পোস্টার দেখা যাচ্ছিল। অর্থাৎ এই সমাবেশ কোন ‘ হটাৎ করে ‘ ঘটে যাওয়া ছিল না। এই কর্মসূচি পালনের সময় ঢাকায় পুলিশের সাথে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়।বহস্পতিবার , ৬ মার্চ ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে জানা যায়। একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি পালনের পিছনে সরকারের প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ অনুমোদন না থাকলে সেই জাতীয় সমাবেশ সম্ভব নয়। হিযবুত তাহরীর রাজপথে নামার সাহস ও অধিকার পেয়েছে সরকারের সম্মতিতে । সরকারের নানাবিধ সংকটে ধর্মীয় রাজনীতিকে ব্যাবহার টিকে থাকার হাতিয়ার হিসাবে সমাবেশের পৃষ্টপোষকতা।
দুই
৫ আগস্টের পর প্রতিটি ধ্বংসযজ্ঞে হিযবুত তাহ্রীর পতাকা ছিল।৭ মার্চ , শুক্রবার হিযবুত তাহ্রীর প্রকাশ্য সমাবেশের উপর পুলিশি হামলা বা ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ২/৪ জন গ্রেফতার হচ্ছে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে হিযবুত তাহ্রীরকে জন মানসে মানিয়ে দেওয়ার পক্রিয়ার অংশ। এই কাজ গুলোতে গণমাধ্যমে রাজনৈতিক দল হিসাবে প্রচার ও বৈধতা পাওয়ার অংশ। এই জাতীয় বা কাছাকাছি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে জেনারেল জিয়া-এরশাদের আমলে জামাত-শিবিরকে বৈধতা দেওয়ার দেওয়া হয়েছে। নিয়ন্ত্রিত ‘ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ‘ আর ‘ নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় সমাদর ‘ নীতি হচ্ছে পুনর্বাসন প্রকল্পের অংশ। পুলিশ প্রটেকশনে পুরো শোডাউন করতে দিয়ে একদম শেষে একটু আইওয়াশ -হিযবুত তাহ্রীর প্রকাশ্য সমাবেশে পুলিশি হামলা। লাঠি চার্জ করে জনগণ ও পশ্চিমা দুনিয়াকে দেখানো ইউনুস সরকার জঙ্গিবাদকে আশ্রয় – প্রশ্রয় থেকে বিরত থাকে। প্রসঙ্গতঃ , তুরুস্ক, পাকিস্তান সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ।
তিন
পুলিশ নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের মিছিল ছত্রভঙ্গ করার সময় রাজধানীর পল্টন থেকে আরমান আলী নাম একজন শ্রমজীবী মানুষকে গ্রেফতার করে। তিনি রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একটি কাঁচামালের আড়তের কর্মচারী বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। পরে আটক কৃত আরমান আলীকে পুলিশ হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা কার্যালয় গিয়ে আরমানকে ছাড়িয়ে আনেন। পরে চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা কার্যালয় গিয়ে আটককৃত জনৈক আরমানকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা এই সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনার দক্ষতা নাই বললেই চলে। উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা গণ কি হিযবুত তাহ্রীরের নাটকের অপেক্ষায় ছিলেন ? যেই না ঘটনা ঘটলো , সেই মাত্র পুলিশ কার্যালয়ে হাজির স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সশরীরে হাজির হওয়ার একটি তৃতীয় শ্রেণির চিত্রনাট্য। অতীতেও এই জাতীয় চিত্র নাট্য দিয়ে জনগণের বোকা বানানোর চেষ্টা হয়েছে। এই যাত্রা নতুন কিছু না !
চার
নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীরের মিছিল সমাবেশের আলোচনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আরমান আলীকে ছাড়ানো ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ‘ মহানুভবতার ‘ কথা সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যে কোন আলোচনা বিশেষ করে উপদেষ্টাদের ‘ মহানুভবতার কাজের ‘ আলোচনা সরকারের ব্যার্থতা গুলো ঢাকতে সাময়িক সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি হিযবুত তাহ্রীরের পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনা দূরে রাখে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ আরমান আলীর গ্রেফতার নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ আরমান আলীর মুক্তির জন্য থানা ঘেরাওয়ের কথা বলেছেন। কেউ কেউ আরমান আলীর পুলিশের সাথে হিযবুত তাহ্রীরের পেটানোতে অংশ গ্রহণ করাকে রাজনৈতিক প্রতিরোধ হিসেবে অতি অভিলাসী হয়ে পড়েছেন । তবে সকল জল্পনা কল্পনার আরমান আলী মুক্ত হয়েছেন। আরমান আলীর হিযবুত তাহ্রীরের পেটানোতে অংশ কোন রাজনৈতিক প্রতিরোধ নয়। পুলিশের কাতারে দাঁড়িয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ অসম্ভব।
পাঁচ
শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় হামলায় হিযবুত তাহ্রীর কালো কাপড়ে কালিমা লেখা পতাকা ব্যাবহার করেছে। এই পতাকা আন্তর্জাতিক ভাবে আইএসআই এর পতাকা। এই পতাকার বিরোধিতা করলে অনেক মুসলিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছেন কালো কাপড়ের উপর লেখা আরবি হচ্ছে কালিমা শাহাদৎ। সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার পর হিযবুত তাহ্রীর কৌশল পরিবর্তন করেছে। ৭ মার্চের সমাবেশে একই পতাকা কালো রঙের কাপড়ের পাশাপাশি সাদা ও হলুদ কাপড়েও উড়িয়েছে হিযবুত তাহ্রীর। এই কৌশল হচ্ছে নরমে – গরমে চলার কৌশল। প্রশ্ন হচ্ছে কালিমা লেখা থাকলেই কি এর বিরোধিতা করা যাবে না। পতাকা হচ্ছে প্রতীক বা শিল্প। সৌদি আরবের পতাকা সবুজ জমিনে কালেমা শাহাদতের নিচে তরবারির ছবি দেওয়া। ছবি সহ আরবি একটি বিশেষ আদলে লেখা। এই জাতীয় লেখাকে ক্যালিওগ্রাফি বলে। আরবি শিল্প সংস্কৃতিতে ক্যালিওগ্রাফি একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে। তবে ক্যালিওগ্রাফি কোন ইসলামিক বিষয় নয়। একটি শিল্প মাত্র। চীন- জাপানের লেখায় ক্যালিওগ্রাফির ব্যাপক ব্যাবহার রয়েছে। কালিমা শাহাদৎ লেখা থাকা সত্ত্বেও কি কেউ সৌদি আরবের পতাকাকে ইসলামের প্রতীক বা কালেমা শাহাদৎ হিসাবে মনে করবেন ? হিযবুত তাহ্রীর পতাকা একই জিনিস। কালো – সাদা বা অন্য কোন কাপড়ে একই ধাঁচে কালেমা শাহাদৎ লেখা হিযবুত তাহ্রীর পতাকা। গত এক দশকে বিভিন্ন দেশে হিযবুত তাহ্রীর পতাকার রং ও ডিজাইন সামান্য পরিবর্তন এনেছে। মূল পতাকার সাথে পরিবর্তিত পতাকার সাদৃশ্য সহজেই চোখে পড়ে।
ছয়
বাংলাদেশের সাধারণ ভাবে বলা হয়ে থাকে মানুষ ধর্ম প্র্রান। সকল ধর্মের মর্ম মূল হচ্ছে অন্য মত ও পথের মানুষকে দাবিয়ে রাখার। এর পা পাশাপাশি ভাল কাজ , দুর্নীতির বিরোধী অনেক ভাল উপদেশ রয়েছে। বাংলদেশের মানুষ যদি ‘ ধর্ম প্রাণ ‘ হতো তবে দেশে কিভাবে দুর্নীতিতে ছেঁয়ে গেল ? ধর্ম ও ধর্মীয় বাণী সমাজে রাজনৈতিক কাজে ব্যাবহৃত হয় জন সমর্থন আদায়ের জন্য। আমাদের সমাজে আরবিতে কিছু বললে বা লেখা দেখলে মানুষ ভক্তিতে গদগদ হয়ে পড়ে। আরবি হচ্ছে একটি ভাষা। ইসলামের শুরুর আগেই এই ভাষা বিকশিত হয়েছিল। আমাদের দেশে যে গুলোকে শুধু মাত্র ইসলামিক শব্দ হিসাবে গণ্য করা হয় এর সব গুলো আরবি ভাষাভাষী অঞ্চলে মুসলিম- খ্রিস্টানরা সমানভাবে ভাবে ব্যাবহার করে। আল্লাহ কিংবা আলহামদুলিল্লাহ এর মত শব্দ গুলো আরবি ভাষী খ্রিস্টানরাও ব্যাবহার করে থাকে। কালেমা শাহাদৎ মুসলিমদের প্রধানতম মর্ম বাণী। এই মর্মবাণী কাপড়ে লিখে পতাকা হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ধর্ম পালনের কোন সম্পর্ক নেই।
খিলাফত বিহীন ১০১ বছর !
ঢাকার রাস্তায় হিযবুত তাহিরীর পোস্টার দেখা যাচ্ছিল বেশ কয়েক দিন ধরেই। সরকারের নির্লিপ্ততা ছিল। অর্থাৎ সরকার হিযবুত তাহিরীকে সভা-সমাবেশের সুযোগ করে দিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উৎপত্তির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। ইউনুস সরকার ৭ মার্চকে বাতিল করে দিয়েছে ইউনুস সরকার। ৭ই মার্চকে অফিসিয়ালি বাতিল করেও স্বস্তি হলো না। হিজবুত তাহরিরকে দিয়ে ‘খিলাফত কায়েম’-এর সমাবেশ এবং পুলিশ দিয়ে দমনের ‘নাটক’ ৭ই মার্চকে মুছে ফেলার চিত্রনাট্যের অংশ। হাসিনা শেখের আমলে ৭ মার্চকে নিয়ে যা হয়েছে তার সাথে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্বের ছিটে ফোটা মিল নেই।
হিযবুত তাহিরীর পোস্টারের শুরু হয়েছে বড় হরফে লেখা ‘ খিলাফত বিহীন ১০১ বছর ” দিয়ে। এই বক্তব্য ভুল ও মিথ্যা। ১০১ বছর আগে কি ঘটেছিল ? ১০১ বছর আগে তুরস্কের ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। এই পতনের মূল ভূমিকায় ছিল তুরস্কের সংস্কার পন্থীরা। যাঁদের নেতৃত্বে বর্তমান তুরস্ক রাষ্ট্রের সূচনা। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সৌদি আরবে ওয়াহাবি আন্দোলন ক্ষমতা নিয়েছে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্ষমতায়। ইরাক, জর্ডান , লেবানন সহ বেশ কিছু রাষ্ট্রের সৃষ্টি এই সময়ে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে ইরাক ও জর্ডান এর বিভিন্ন এলাকা স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। ১০১ বছর আগে পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিমের বসবাস ছিল ইরান , তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত [ ভারত -পাকিস্তান-বাংলাদেশ ] আফগানিস্তান এবং রাশিয়ার অন্তর্গত তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান এর মত দেশ গুলো। এই সব দেশে কখনো ওসমানীয় সাম্রজ্যে -খেলাফতের অংশ ছিল না। ইয়েমেন, মিশর কিংবা উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ গুলোর উপর ওসমানী সাম্রাজ্যের অতি দুর্বল ছিল। ওসমানী সাম্রাজ্যের নানা বাঁকে এই এই দেশ গুলোতে খেলাফত – ওসমানী সাম্রাজ্যের অংশ ছিল না। ১০১ বছর আগে সারা দুনিয়া থেকে খেলাফত উধাও হয়ে গেছে এমন দাবি মিথ্যা ইতিহাস। ওসমানীয় শাসনের অবসানের ফলে মুসলিম দুনিয়া ৫৫/৫৭ দেশে ভাগ হয়েছে এমন ধারণা ঐতিহাসিক ভাবে ভুল। ভুল ইতিহাস ও ধর্মীয় আবেগ দিয়ে রাজনীতির বিপরীতে সঠিক ইতিহাস ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিকল্প নেই।