৭ মার্চ, শুক্রবার নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর প্রকাশ্যে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে ঢাকায়। হিযবুত তাহ্রীর রাজনীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নানা আলোচনা হচ্ছে। হিযবুত তাহরীর আরবি শব্দের বাংলা অর্থ ভাষায়: মুক্তির দল। হিযবুত তাহরীর লক্ষ্য হল ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠা। হিজবুত তাহরীর পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, লেবানন, ইয়েমেন, বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে নিষিদ্ধ। বিভিন্ন সময়ে হিজবুত তাহরীর নিয়ে আলোচনা ও এখানে সেখানে এই দলের নেতা – কর্মীদের গ্রেফতার সংবাদ সামনে এসেছে। আওয়ামীলীগ সরকার বিভিন্ন সময় হিযবুত -হেফাজত -জামায়েত এর মত রাজনৈতিক দল গুলোর বিরুদ্ধে মামলা মোকর্দমাকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলেছে। কিন্তু এই সব মামলাকে সঠিক ভাবে বিচার ও ধর্মিয় রাজনীতির উত্থান – পৃষ্টপোষকতা ঠেকানোর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও আইনগত পদক্ষেপে আগ্রহী ছিল না। ৫ অগাস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনার পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় হামলায় হিযবুত তাহ্রীর পতাকা ব্যাবহৃত হয়েছে। গত সাত মাস প্রকাশ্যে রাজনীতি করে আসছে। সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনায়র পর কালো জমিনে কালিমা লেখা পতাকা সাদা বা অন্য রঙের কাপড়ের উপর নিয়ে ব্যাবহারের নজির রয়েছে। প্রশ্ন বিভিন্ন ইসলাম পন্থী রাজনৈতিক দল গুলোর প্রতি ইউনুস সরকার ও সেনাবাহিনীর আদুরে মনোভাব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ছিল । ৫ আগস্টের পর , প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম গুলো ইউনুস সরকারের বিভিন্ন বিষয় গুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রাখছে। অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় প্রতিষ্টিত গণমাধ্যম গুলো সরকার পন্থী অবস্থানে।
নভেম্বর ২০২৪ সালের শুরুতে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম হিযবুত তাহরীরের সদস্য এমন সংবাদ প্রথমে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম হয়ে গণমাধমে ঠাঁই পেয়েছিল। এই সংবাদ বিভিন্ন ভাবে গুঞ্জন তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিল। ইউনুস সরকারের প্রেস উইং এবং মাহফুজ আলম বিষয়টিকে গুজব হিসাবে নাকচ করে দিয়েছে। ৪ নভেম্বর ২০২৪ সালে কালের কণ্ঠ এই বিষয়ে সরকারি ভাষ্য তুলে ধরে ” অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হিসেবে দাবি করে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্টটি গুজব বলে জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং ফ্যাক্টস। গুজব প্রতিরোধে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে চালু করা ফেসবুক পেইজে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমকে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হিসেবে দাবি করে ফেসবুকে বেশ কিছু পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এতে ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট রয়েছে, যেখানে আবদুল্লাহ আল মাহফুজ নামে এক ব্যক্তিকে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, অভিযুক্ত আবদুল্লাহ আল মাহফুজ ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম দুজন ভিন্ন ব্যক্তি। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মাহফুজ আলম। তিনি কখনোই হিজবুত-তাহরীর বা অন্য কোনো নিষিদ্ধ বা ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন না বলে একটি পোস্টে জানিয়েছেন। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়ে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের জবাব দিয়েছেন মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, আমি ইসলামপন্থী বা জঙ্গী বিশেষ করে হিযবুত তাহরীর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে কিছু ভারতীয় মিডিয়া ও আওয়ামী লীগের গুজব সেলে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এসব দাবি অস্বীকার করে তিনি বলেন, আমি হিযবুত তাহরীর বা অন্য কোনো অগণতান্ত্রিক দলের আদর্শের বিরুদ্ধে আগেও ছিলাম এবং এখনো আছি। তিনি ছাত্রশিবিরের সদস্য এবং সুবিধাভোগী ছিলেন না বলেও জানান তিনি।”
হিযবুত তাহ্রীর রাজনীতি নিয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। এদের প্রকাশিত কিছু বই পুস্তক রয়েছে। সেগুলো থেকে খুব বেশি কিছু উদ্ধার করা সম্ভব নয়। দলটি গুপ্ত সংগঠন । অতি সামান্যই বক্তব্য সামনে এনেছে। বাংলাদেশকে বাদ দিলেও অন্য মুসলিম রাষ্ট্র গুলোতে হিযবুত তাহ্রীর নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধের পিছনে গুপ্ত তৎপরতা ও প্রকাশিত বক্তব্য বহুল অংশে দায়ী। হিযবুত তাহ্রীর খেলাফত প্রতিষ্টার কথা বলছেন। খেলাফত নিয়ে ভারতীয় মুসলিম সমাজে ধারণা ঘোট পাকানো। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পরে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন হয়। এই সময় ভারতীয় মুসলিমরা ‘ খেলাফত আন্দোলন ‘ নামে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারকে তুরুস্কে খেলাফত প্রতিষ্টার জন্য চাপ দেওয়া। এই দাবি ছিল বিকারগ্রস্থ। বুঝে না বুঝে ভারতীয় মুসলিমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তুরুস্কের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে তুরুস্ক বা ওসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙে বিভিন্ন রাষ্ট্র তৈরী হওয়ার কোন অঞ্চলে ওসমানীয় খেলাফত ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। তবে কয়েক দশক পরে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনকে মহিমান্বিত করে প্রথমে মিশর ও অন্যান্য আরব দেশ গুলোতে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা হয়।
হিযবুত তাহ্রীর বাংলাদেশের রাষ্ট্রের ভাষাকে আরবি করতে চায়। হিযবুত তাহ্রীর খিলাফত রাষ্ট্রের সংবিধান ( খসড়া ) প্রকাশ করেছে। বইয়ের প্রচ্ছদে লেখা ” খিলাফত রাষ্ট্রের খসড়া সংবিধানের অনুচ্ছেদ সুমুহের বাংলা অনুবাদ কৃত সংকলন। ” শুরুতেই সামান্য হোঁচট। সাধারণ মানুষ আরবি ভাষায় শিক্ষিত নয়। আরবি ভাষায় প্রকাশনা কখনোই জনগণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই রাষ্ট্র ভাষা আরবির দাবি সম্বলিত পুস্তিকা বাংলায় অনুবাদ করতে হয়েছে। অনেকটা মোহাম্মদ আলীর রাষ্ট্র ভাষা ঊর্দু এই ঘোষণাটি ইংরেজিতে দিতে হয়েছিল।
আরবি একটি ভাষা। ইসলাম আরব থেকে শুরু হয়েছে । ইসলামের আদি বই পুস্তক আরবিতে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবি ভাষায় কাব্য সাহিত্য চর্চার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। ইসলামের শুরুতে যারা এই ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাদের সকলের ভাষা ছিল আরবি। ইসলামের বিকাশের সাথে সাথে ধর্মের সাথে আরবি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার নীতি কৌশল গৃহীত হয়েছিল। আরবদের ইরান বিজয়ের পর আরবি ভাষা চাপিয়ে দেওয়া প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। আরব আগ্রাসন পারস্যের বর্ণমালাকে বাদ দিয়ে আরবি বর্ণমালাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হলেও ভাষা হিসাবে পার্শী হিসাবে টিকে আছে ইরানে। সম্ভবতঃ এটাই হচ্ছে আরবিকরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ, ভাষা রক্ষার আন্দোলন।
১৯২৪ সাল পর্যন্ত ওসমানীয় সাম্রাজ্যে তুর্কি ভাষা আরবি বর্ণমালায় লেখা হতো। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর তুরুস্ক আরবি বর্ণমালার পরিবর্তে রোমান হরফে তুর্কি ভাষা লেখা হয়ে আসছে। মধ্য যুগে বাংলাকে আরবি বর্ণমালায় লেখার চেষ্টা হয়েছিল। পাকিস্তান পর্বে বাংলাকে আরবি বর্ণমালায় লেখার সরকারি প্রচেষ্টা ছিল একটি দেশের ভাষা সাহিত্য বদলে দেওয়া , একটি জাতিকে পিছিয়ে দেওয়ার প্রকল্প। আরবিকে রাষ্ট্র ভাষা করার শোরগোল হচ্ছে কোরানের ভাষা হিসাবে আরবির প্রতি বাংলাদেশের মুসলিমদের অন্ধ আবেগকে ব্যাবহার করা হিযবুত তাহ্রীর রাজনীতি।
অনৈসলামিক সংগঠন
হিযবুত তাহ্রীর খিলাফতের পতনের ১০১ বছর উপলক্ষে ৭ মার্চ ২০২৫ সমাবেশ মিছিল করেছে। ইসলামের প্রথম ৪ জন খলিফার খোলাফায়ে রাশেদীন যুগ বলা হয়। এই শাসনামলের পর মধ্য প্রাচ্যে আরো ৫ টা খিলাফেত দেখি। উমাইয়া, আব্বাসী, ফাতিমি, মামলুক আর ওসমানীয় -তুরস্ক । খিলাফত দাবিদার হলেও এই শাসন গুলো ছিল রাজতন্ত্র। রাজার ছেলে রাজা হওয়ার পদ্ধতি। মুসলিম সমাজে কোনটি সঠিক ‘ খিলাফত ‘ তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ও হাঙ্গামা রয়েছে। হিযবুত তাহ্রীর খসড়া সংবিধানের ১৮৬ ধারায় ” অনৈসলামিক সংগঠন এ যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ ( যেমন জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত ইত্যাদি) যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ করণের ডাক দেওয়া হয়েছে। আজকের দুনিয়ায় জাতিসংঘের সদস্য ছাড়া বাংলাদেশের মত অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রের টিকে থাকা কোন ভাবেই সম্ভব না। জাতি সংঘ থেকে প্রত্যাহারের সাথে সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা শুরু হবে। বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ব্যবসা বাণিজ্য চাকুরী , বৈদেশিক ঋণ সহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ দেউলিয়াত্বের দিকে ধাবিত হবে।
হিযবুত তাহ্রীর রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত থেকে প্রত্যাহারের কথা বলছে। আন্তর্জাতিক আদালত নিয়ে বেশ কিছু সমালোচনা আছে। তবে এই আদালতের মাধম্যে ইসরাইলের বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিরুদ্ধে সমন জারি করা সম্ভব হয়েছে। প্যালেস্টাইনে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে অবৈধ ঘোষণাকে করেছে আন্তর্জাতিক আদালত। আন্তর্জাতিক আদালতের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমেরিকা ও ইসরাইল আন্তর্জাতিক আদালতের কট্টর সমালোচক এবং এর সদস্য নন। আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত ইসরাইলের দখলের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য ভূমিকা রেখে আসছে। আন্তর্জাতিক আদালত না থাকলে বা যেটুকু কার্যকর আছে সেটুক অকার্যকর হলে সবচেয়ে বড় লাভবান হবে আমেরিকা ও ইসরাইল।
শিক্ষা ব্যবস্থা
হিযবুত তাহরীরর ভবিষৎ শিক্ষা ব্যাবস্থার বিবরণ হিযবুত তাহরীরর খসড়া সংবিধানে পাওয়া যায়।
ধারা ১৬৯: পরীক্ষালব্ধ বিজ্ঞান (যেমন গণিত, কৃষিবিদ্যা) প্রয়োজন অনুসারী শেখানো যাবে।
ধারা ১৭১: সাংস্কৃতিক যেসব বিষয় ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক ( যেমন চারুকলা, ভাস্কর্য শিল্প) সেগুলা শেখানো যাবে না।
ধারা ১৭২: রাষ্ট্রীয় সিলেবাস বাদে অন্য কোনো সিলেবাসে কোথাও পড়ানো যাবে না।
ধারা ১৭২: শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কোনো পর্যায়েই নারী-পুরুষ মেলামেশা করতে পারবে না।
এই ধারা গুলোর সব কিছুই জ্ঞান – বিজ্ঞান বিরোধী। জ্ঞান -শিক্ষার আলো জ্বালিয়ে রাখার প্রত্যয়ে হিযবুত তাহরীরর শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা প্রয়োজন।
হিযবুত তাহ্রীর খসড়া সংবিধানে অমুসলিমদের কাছ থেকে রাষ্ট্র জিজিয়া কর আদায়। অগণতান্ত্রিক বিচার ব্যাবস্থা , একবার নির্বাচিত খলিফা পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। এই খসড়া সংবিধান দেশ ও জনগণকে পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার হাতিয়ার।