প্রতিবছর ঈদের আগে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নামতে হয়। শ্রমিকদের এই ন্যায্য দাবিকে প্রায়ই মালিকপক্ষ ও সরকার নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করে থাকে। মালিকপক্ষের অভিযোগ, শ্রমিকরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে বিপদে ফেলতে চায়। এছাড়াও বিদেশি ষড়যন্ত্রের অজুহাত দিয়েও শ্রমিক অসন্তোষকে অযৌক্তিকভাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলে।
এ বছর ঈদের আগেও একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সরকারের নির্দেশ ছিল ২০ রমজানের মধ্যেই শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধ করার। কিন্তু বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, বহু কারখানা নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকদের বেতন ও বোনাস দেয়নি। বিশেষ করে বন্ধ বা আর্থিক সংকটে থাকা কারখানাগুলোতে এই সমস্যা প্রকট। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলসহ বেশ কয়েকটি জেলায় অন্তত ৪৩টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। কালিয়াকৈরের মাহমুদ জিনস এবং ময়মনসিংহের ভালুকায় রোর ফ্যাশনের শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করেছে, যার ফলে একজন শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ইতোমধ্যেই ১২ জন গার্মেন্টস মালিকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এছাড়াও যারা এখনো বেতন-বোনাস পরিশোধ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা এসেছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একইসাথে শ্রমিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, অযৌক্তিক ও অন্যায্য দাবিতে শিল্প খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অধিকাংশ গার্মেন্টস শ্রমিক নিয়মিত মাসিক বেতন প্রতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে পায় না। কাজের বেতন চাওয়াকে ‘ অযৌক্তিক ও অন্যায্য ‘ হিসাবে হুঁশিয়ারি দেওয়া মালিক পক্ষকে বেতন না দেওয়ার ইন্ধন দিচ্ছে। বেতন – ভাতা না দেওয়ার জন্য বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি কোন সমাধান নয়। এমনকি আইনি পদক্ষেপ নয়। শ্রমিকের বেতন না দেওয়া , বেতন না দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ফৌজদারি অপরাধ। বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি লোক দেখানো , দৃষ্টি সরানো শোরগোল চড়া অন্য কিছু নয়।
গার্মেন্টস শিল্পে বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষ দীর্ঘদিনের সমস্যা। মালিকপক্ষের নিয়মিত অজুহাত ও গড়িমসির কারণে শ্রমিকরা তাদের প্রাপ্য সময়মতো পায় না। এখানে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নাগরিকের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার শপথ নিয়েই দায়িত্ব পালন করে। ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। শ্রমিকরা যদি তাদের মৌলিক অধিকার হিসেবে বেতন-বোনাস না পায়, তাহলে সরকারের দায়িত্ব শুধু বেড়েই যায় না, বরং তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সরকারের নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
মিডিয়ার ভূমিকা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। অনেকেই মনে করেন, মালিকপক্ষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করছে। এর ফলে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাঝে শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হয় না। শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে বিদেশি ষড়যন্ত্র বা অযৌক্তিক দাবির অজুহাত সামনে এনে মূল সমস্যাগুলো আড়াল করার প্রবণতা লক্ষণীয়।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ, এবং গণমাধ্যমে সত্য তথ্য প্রচার। সরকারের শক্ত অবস্থান নেওয়া ছাড়া শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ দায়িত্ব সরকারেরই, এবং শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে কোনোরকম ছাড় না দেওয়া সরকারের নৈতিক কর্তব্য ও আইনি দায়িত্ব।