বাংলাদেশের ইতিহাসে বিচারব্যবস্থা কখনোই পুরোপুরি আশার আলো হয়ে উঠতে পারেনি। বরং তা বারবার উদ্বেগ ও সংশয়ের কারণ । বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সংকট বা নিপীড়নমূলক শাসনের পরবর্তী সময়ে অতীত অপরাধের বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, বাংলাদেশে এর বাস্তবায়ন প্রায়শই বিতর্কিত হয়েছে। সম্প্রতি জুলাই-অগাস্ট ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারের নামে একের পর এক মামলা ও গ্রেফতার সেই বিতর্ককেই নতুনভাবে সামনে এনেছে। বিশেষ করে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অস্পষ্ট ও বিতর্কিত অভিযোগে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হচ্ছে, তাতে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা দুর্বল হয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি ৭ এপ্রিল ২০২৫-এ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে একটি কথিত হত্যা প্রচেষ্টার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, যা ঘটেছিল ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এই মামলার আসামি সংখ্যা ৫০। তুরিন আফরোজ এই মামলার ৩০ নম্বর আসামি এবং একমাত্র আসামি। প্রায় সাত মাস পর হঠাৎ করেই এই মামলা দায়ের ও তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার প্রশ্নবিদ্ধ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা আবদুল জব্বার হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পিপি ওমর ফারুক ফারুকী আদালতে বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পক্ষে কথা বলতেন তুরিন আফরোজ। সুপ্রিম কোর্টের যে কয়েকজন আইনজীবী ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের অন্যতম তুরিন আফরোজ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে তাঁকে নিয়োগ দেন হাসিনা। কাকতলীয় ভাবে, তুরিন আফরোজের গ্রেফতারের পর তার বৈমাত্রীয় ভাই তুরিন আফরোজের বাসা দখলের চেষ্টা চালান হয়। প্রসঙ্গত পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে তুরিন আফরোজ বৈমাত্রীয় ভাই ও মায়ের সাথে আইনি বিরোধে যুক্ত। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ও মামলার নিস্পতিতে অতি দীর্ঘসূত্রিতা একটি সামাজিক বাস্তবতা। মুসলিম পরিবারে বহুবিবাহের প্রচলন বিষয়টিকে আরো জটিল করে তোলে। তুরিন আফরোজের গ্রেফতারের পর এই পারিবারিক বিরোধের নানান সংবাদ গণমাধ্যমে এনে বর্তমানের বিচারহীনতাকে ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে ‘ হত্যা প্রচেষ্টা ‘ ও পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে মামলা দুটি পৃথক মামলা। ন্যায় বিচারের স্বার্থে দুটি মামলার পৃথক ও নিরেপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রয়োজন।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তুরিন আফরোজ। জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজমের মামলাসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা তিনি পরিচালনা করেছেন।
২০১৭ সালের নভেম্বরে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার তুরিন। তবে আসামির সঙ্গে আইন বহির্ভুতভাবে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ওই মামলার বিচারকাজ চলাকালেই ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরের বছর ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে অপসারণ করে তখনকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। আলোচিত থেকে বিতর্কিত হয়ে পড়েন তুরিন আফরোজ।
১৬ সেপ্টম্বর ২০২৪ সালে শাহরিয়ার কবিরকে রমনা থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হলেও তার নামে ঢাকার একাধিক থানায় কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে । গত ২০শে অগাস্ট হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি হারুন ইজাহার চৌধুরী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১৩ সালের পাঁচই মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ করেন। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ২৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এই ২৪ জনের মাঝে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির শাহরিয়ার কবিরের নামও আছে।
শাহরিয়ার কবির লেখক ও সাংবাদিক। বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল সম্পদ হিশেবে বহুকাল ধরে দীপ্তি ছড়াবে শাহরিয়ার কবিরের বেশ কিছু বই। নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড়, হারিয়ে যাওয়ার ঠিকানা, একাত্তরের যীশু, নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা,আবুদের অ্যাডভেঞ্চার,পুবের সূর্য, পাথারিয়ার খনি রহস্য, আলোর পাখিরা, সীমান্তে সংঘাত, মিছিলের একজন, সাধু গ্রেগরীর দিনগুলি, হানাবাড়ির রহস্য, ব্যভারিয়ার রহস্যময় দুর্গ, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, একাত্তরের পথের ধারে, বার্চবনে ঝড়, নিশির ডাক, কিংবা কার্পথিয়ানের কালো গোলাপ শাহরিয়ার কবিরের বই গুলোর অন্যতম । সত্তরের দশকের শুরুতেনকশাল আন্দোলন উপমহাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, যার ঢেউ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছেছিলো, সেই ‘নকশাল’ আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস ‘ওদের জানিয়ে দাও’।
শাহরিয়ার কবিরের অন্যদের সাথে সম্পাদনা করেছেন ‘ একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায় হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সরাসরি লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী বাঙালিদের তালিকা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত একটি দালিলিক প্রমাণ গ্রন্থ। এই বইটি ১৯৮৭ সালে ঢাকা থেকে “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ কেন্দ্র” কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
১৯৯১ সালের ২৯শে ডিসেম্বর একাত্তরের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী এবং তখনো পাকিস্তানের নাগরিক গোলাম আজমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের আমীর ঘোষণা করেছে। তখনই দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম প্রধান নেতা শাহরিয়ার কবির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বরুপ উন্মোচনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বড় ভূমিকা রয়েছে । অতীতে এই সংগঠনটির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় সরকারের রোষানলেও পড়েছেন। বিশেষ করে বিএনপি সরকারের সময়।
তুরিন আফরোজের মতো আইনজীবী বা শাহরিয়ার কবিরের মতো সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা জনসমাজে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। বিশেষত হত্যার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন এমন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করলে প্রকৃত অপরাধীদের বিচারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। এসব মামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ভিন্নমতের নাগরিকদের অধিকার আইনি বৈধতার মধ্য দিয়েই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শাহরিয়ার কবির বা তুরিন আফরোজের গ্রেফতার তাই এক ধরনের অঘোষিত জরুরি অবস্থার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে আইনের প্রয়োগ সমান নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত।
অসুস্থ সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী শাহরিয়ার কবিরকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক অভিযোগে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে আদর্শিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার একটি লক্ষণ, যেখানে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংহত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। শাহরিয়ার কবিরের অসুস্থ শরীরের প্রতি উদাসীন থেকে রাষ্ট্রের শারীরিক নিয়ন্ত্রণ প্রদর্শন করা হচ্ছে, যা আধুনিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের পরিচায়ক। জনতুষ্টিবাদের আড়ালে ভিন্নমতকে দমন করতে ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করায় রাষ্ট্রের আদর্শিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটছে। বিচারব্যবস্থা কখনোই শুধু আইন ও তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় না, বরং এর একটি শক্তিশালী প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সমাজকে একটি বার্তা দেয়—কে ‘শত্রু’, কে ‘বন্ধু’। এই বিচারিক পদ্ধতি রাষ্ট্রের আদর্শিক নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার হাতিয়ারে পরিণত হয়। তুরিন আফরোজ বা শাহরিয়ার কবিরের মতো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক মামলা ও তাদের গ্রেফতার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ক্ষমতার সম্পর্কের গভীর সংকটকে প্রতিফলিত করে। এসব ঘটনা আমাদের সামনে গভীরতর প্রশ্ন হাজির করে: বাংলাদেশে বর্তমানে বিচার কি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে, নাকি তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?