বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৮ অপরাহ্ন

গণতন্ত্রের কাফের তল্লা বিহিন  – বুলবুল তালুকদার

বুলবুল তালুকদার 
মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

“খোলা জানালা”- লেখার শুরুতেই ছোট্ট একটি গল্প বলি:
ছেলের নতুন বউ। বউটি বেশ ছোটোখাটো মানে বেটে প্রকৃতির। শাশুরি আত্মাকে রান্নাবান্নায় সহযোগিতা করতে ছেলের বউ মটকা থেকে রান্না করার পানি তুলে দিচ্ছে। হঠাৎই নতুন বউয়ের গলায় থাকা সোনার হারটি খুলে মটকায় পড়ে যায়। নতুন বউ চিৎকার করে বলে উঠে, আম্মা সর্বনাশ হয়ে গেছে। গলার হার মটকায় পড়ে গেছে।
শাশুরি আম্মা বলে, অসুবিধে কি? মটকার তলায় খুঁজে পেয়ে যাবে। ছেলের বউ মটকার পানিতে হাত দিয়ে এদিক সেদিক হাতিয়েও সোনার হারের কোন হদিস পায় না। বউ আবার চিৎকার করে বলে উঠে, আম্মা মটকায় হার নাই।
শাশুরি বলে বউমা মটকার তলাতে খুঁজে দেখ মিলে যাবে হার। বউ আবার মটকার চারিদিকে হাতাচ্ছে আর মনে মনে ভাবছে, আম্মাজান আসলেই পুরানো যুগের মানুষ, বোকা প্রকৃতির হবে এবং বয়সের ভারেও সব গুলিয়ে ফেলছে। কি সব কথা যে বলেন আম্মাজান? মটকার তলাতে খুঁজতে।
বউ এবার চিৎকার করে বলে, আম্মাজান কি যে আবল- তাবল বলেন আপনি, মটকার কোন তল্লাই নাই। আসলে ছেলের বউ বেটে প্রকৃতির এবং হাতগুলো একেবারেই ছোটো। মটকার তলদেশ পর্যন্ত হাত পৌঁছায়নি।
লেখার হেড লাইনেই একটি শব্দ আছে, “কাফের”। না, এই কাফের আমাদের তথাকথিত কাফের নয়। এটা কতগুলো দেশের নামের প্রথম অক্ষরগুলো নিয়ে একটি শব্দ মাত্র। শব্দটি হলো “CAFER” অর্থাৎ CHINA- AMERICA- FRENCH- ENGLAND- RUSSIA এই পাঁচটি দেশকে কেন টানছি গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে?
লক্ষ্য করুন, জাতিসংঘ বিশ্বের বহুদেশের একটি সম্মিলিত সংগঠন। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংগঠনকে বিশেষ রাষ্ট্রের বিশেষ সংগঠন বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, বিশেষ কারণেই (ওটা এই লেখার বিষয় নয়)। জাতিসংঘে পাঁচটি দেশ রয়েছে যারা জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং এই পাঁচটি দেশের সর্বত্রই ভেটো দেবার ক্ষমতা রয়েছে।
বিশ্বে আজ অবধি এই পাঁচ দেশের কোন এক দেশের ভেটো দেবার পরে সেই ভেটোকে লঙ্ঘন করা হয়নি। তবে হ্যা একবার সেটা ঘটেছে এবং মাত্র একবারই। ঠিক সে কারণেই আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সংগঠনকে বিশ্বের দেশগুলোর সংগঠন না বলে, বিশেষ রাষ্ট্রের সংগঠন বলতে
স্বাচ্ছন্দ্য পাই। কিভাবে ঘটেছে?
আপনাদের স্মরণে আছে নিশ্চয়ই, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র জর্জ ডাব্লিউ বুশের সেই বিখ্যাত উক্তিটি কথা? “Either you are with us or with terrorists” কথাটি জুনিয়র জর্জ ডাব্লিউ বুশ ইরাক যুদ্ধে আগে জাতিসংঘের ভেটোর বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছিলেন এবং ভেটোর বিপরীতে গিয়েই ইরাকে হামলা চালিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে ছিলেন। অতঃপর পরের ইতিহাস অনেক লম্বা তবে ফলাফলটি আপনাদের সবার নিশ্চয়ই জানা আছে। ইরাকে কোন কেমিক্যাল অস্ত্র (গণবিধ্বংসী অস্ত্র) অবশেষে মিলেনি।
আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, ইরাক যুদ্ধের তের বছর পরে ইরাক আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্রিটেনের যোগ দেয়া নিয়ে যে তদন্ত হয়েছে, তার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার যে পরিস্থিতিতে যুদ্ধে যাবার আইনগত ভিত্তি ছিল বলে মনে করেছিল, সেটা মোটেই সন্তোষজনক নয়- বচনে তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জন চিলকট।
আপনাদের আরও স্মরণ থাকার কথা ইরাকে যুদ্ধ শেষ হয়েছিল আমেরিকার সামরিক বাহিনীর প্রধানের সেই উক্তি দিয়ে, “we got him” অর্থাৎ সাদ্দামকে পাওয়া গেছে, যুদ্ধ শেষ অতঃপর আন্তর্জাতিক আদালতে সাদ্দামের ফাঁসি এবং ইরাক যুদ্ধের নতুন ইতিহাস। না, এই ইতিহাস শেষ হবার নয়। যুদ্ধের ২০ বছর পর এখন নতুন করে সে বিতর্ক ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ইরাকের কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে নতুন তথ্য সামনে এসেছে। বিবিসির ‘শক অ্যান্ড ওয়ার: ইরাক টোয়েন্টি ইয়ারস অন’ নামে নতুন এক সিরিজে। অতঃপর প্রমাণ হয়েছে যে, গণতন্ত্রের নামে, মানুষ বাঁচানোর নামে, বিশ্বকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার নামে, ইরাকে যা ঘটেছিল, সেটা সাদ্দামের কাছে ‘রবার ব্যান্ড’ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রাসন চালাত: মার্কিন কর্মকর্তারাই সেগুলোর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও চর্চা হবেই হবে।
ভাবতে পারেন কেন আমি গণতন্ত্র- মানবতা ইত্যাদি বলতে গিয়ে ইরাক যুদ্ধ টেনে আনছি এবং কেনইবা আমি জাতিসংঘের প্রসংগ টেনে আনছি? কারণটি বেশ পরিষ্কার। মানবতা- গণতন্ত্র এগুলো হলো জাতিসংঘের মূল উপসর্গ তবে জাতিসংঘ কি সেগুলো মানে? উত্তরটি হচ্ছে সরাসরি না।
উপরেই জাতিসংঘের স্থায়ী কমিটির কথা উল্লেখ করেছি এবং উল্লেখ করেছি সদস্যদের কথা। কফের (CAFER) নামকরণ করে। লক্ষ্য করুন, যে জাতিসংঘ মানবতা আর গণতন্ত্র নামক টেবলেট পৃথিবী ব্যাপী বিক্রি করে অথচ তাদের ভিতরে কি চর্চা হয়? তাহলেই বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।
লক্ষ্য করুন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা হলো ১৫ টি। এর মধ্য স্থায়ী পাঁচটি দেশের (KAFER) আজীবন জন্য নিয়োজিত হয়ে আছে। এখানে বলতেই হয় গণতন্ত্র বলে কথা। আর বাকি দশটি দেশ প্রতি দুই বছর পরপর নিয়োগ পায়। তাহলে এই সামান্য সমীকরণটি মিলিয়ে দেখুন, জাতিসংঘের গণতন্ত্রের বয়ান বা মানবতার বয়ান কতটা ধোঁকায় ভরপুর।
ভেটো বিষয়টি এমন যে, একটি দেশ যে কোন বিষয়ে ভেটো দিলেই সব নষ্ট তবে মার্কিনিদের উদহারণটি একটু ভিন্নভাবে হিসেবে নিবেন। সেখানেই বিশ্বের শক্তির একটি সাইন (Sign) রয়েছে (ওটা আজকে আলোচনার বিষয় নয়)। তবে একটি ভিন্ন ও বিশ্বব্যাপী সাম্প্রতিক (বহুকাল চলমান) উদহারণ দেই তাহলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। স্মরণে রাখুন, বিশ্বের ১৩৯ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বাধীনতা দেবার প্রস্তাব আজ অবধি বহুবার বহুভাবেই তুলেছে। সাম্প্রতিক স্থায়ী কমিটির সদস্য ফ্রান্স আবার নতুন করে ভাবছে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব দেবে, স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। কি ভাবছেন? স্থায়ী কমিটির সদস্য বলে সেটা হয়ে যাবে ? উত্তরটি হচ্ছে ওই যে পাঁচ স্থায়ী কমিটির এক সদস্য এবং শক্তিধর সদস্য আমেরিকা আছে তাই ওটা হবার নয়।
একমাত্র তখনই হবে বা হতে পারে, হয় আমেরিকা পূর্বে ইরাকের যুদ্ধের সময় যেভাবে ভেটোকে অবজ্ঞা করেছিল, তেমন কিছু ঘটলে। নতুবা নয়। তাহলে প্রশ্ন মনে মনে উঠতে পারে, তাহলে স্থায়ী কমিটির বাকি চার সদস্য কি হাওয়াই মিঠাই? জ্বি হা, আজ অবধি তেমনটা বলাই বাহুল্য কেননা ইরাক যুদ্ধ সেটার প্রমাণ। এখানে আরও একটু বলে রাখি, সেই ইরাক যুদ্ধে সবাই কিন্ত আবার লাভের আশায় এক হয়ে গিয়েছিল। ছোট্ট করে বলি, ইরাকের মাটির নিচে অপরিশোধীত বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের ৬৪% তেল কিন্ত এখন আর ইরাকের মাটির নিচে নেই। হওয়া হয়ে গেছে যুদ্ধের নামে।
লেখার শেষে প্রথমেই বলা গল্পের কথা দিয়েই শেষ করব। গণতন্ত্র বলেন আর মানবাধিকার বলেন বা ভিন্ন কিছু, সব কিছুই আছে তবে সেটা ওই মটকার তলদেশে অর্থাৎ তলদেশটা জাতিসংঘ নয় এবং বিশ্বের ভিন্ন কোন দেশেও নয়, কেননা বিশ্ব কথা বলেই শক্তি দিয়ে। সেই তরদেশটি মূলত মার্কিন মুল্লুক। তাই হাতিয়েও কুলাবে না এবং সোনার হারটাও মিলবে না। ওই তলদেশ নিয়েই বিশ্বে আগামীর তৃতীয় মহা যুদ্ধ হবে। সেখানেই চীনের উঠে আসা মার্কিনিদের জন্য বড় ভাবনা।
তলদেশের অধিকারী হতে মানবাধিকার বা গণতন্ত্র সব আরেকবার বিশ্বে বিনষ্ট শতভাগ হবেই হবে। কে জানে, আমরা গণতন্ত্রের খোঁজে ভৌগলিক কারণেই সেই তলদেশের প্রধান উপসর্গ হয়ে উঠি কিনা? জানি না বুঝাতে পারলাম কিনা? তবে মটকার তলদেশ’ও বর্তমান আছে এবং শাশুরি আম্মার’ও বিবেক- বুদ্ধি আছে। অযাচিত আমরা হাতিয়ে বেড়াচ্ছি না তো? সুতরাং আসুন যতটুকু সম্ভব নিজেদের বিবেক দিয়ে সম্মিলিতভাবে দেশ নিয়ে ভাবি এবং যতটা সম্ভব একত্রিত আগাই। তা না হলে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের নামে ওরা এসে সব বিনষ্ট করে দেবে। সময়েই সাধু সাবধান।
বুলবুল তালুকদার
অষ্ট্রিয়া – লিঞ্জ
সমসমাজ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য
সমসমাজ.কম


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!