বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনীেিততে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধানতম মিত্র ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী চীন-পাকিস্তানের সঙ্গে বির্্্ােেধ নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলেও একসময় মিত্র হিসেবে পায় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। এছাড়াও ২৪ অক্টোবর থেকে ভারতের কংগ্রেস দলীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক জনমত বুঝতে ১৯ দিনের সফরে বের হন পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। ভারত প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্যে দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, নিজ ক্ষমতাবলে ‘পূর্ব পাকিস্তান’কে মুক্ত করার। প্রবাসী সরকারের ১১ সেক্টরককে ভেঙ্গে পরিণত করা হয় ৪ টি সেক্টরে। ততদিনে পাকিস্তানও তার যুদ্ধ কৌশল পাল্টে ফেলে। আটটি ঘাঁটি স্থাপন করে সেখানে আশ্রয় নিতে শুরু করে পাকসেনারা। ফলে সীমান্ত-যুদ্ধ কমে আসতে শুরু করে। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও কিছু এফএফ মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া অন্যদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠানো শুরু হয় সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের। এমনকি ইয়থ ক্যাম্পগুলো থেকেও মুক্তিযোদ্ধারা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ চলে আসতে থাকে নিজ নিজ এলাকায়। অক্টোবর থেকে সিরাজগঞ্জে আসতে শুরু করে সীমান্ত এলাকায় ব্যস্ত থাকা এফএফ মুক্তিযোদ্ধারা। এতে দ্রæত বৃদ্ধি পেতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি। বড় ধরণের আক্রমন পরিকল্পনা করতে শুরু করে তারা। বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ মিলিতভাবে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ভাটপিয়ারী হাই স্কুল প্রাঙ্গণে স্থাপিত রাজাকার ও পাকসেনা ক্যাম্পে। এ যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সিরাজগঞ্জ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াই। ৩১ অক্টোবর সেখানে হামলা চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দখলে নেয় সে ক্যাম্প। হত্যা করা হয় অন্তত ৪০ জন রাজাকারকে, পালিয়ে যায় অন্যরা। ওই যুদ্ধে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ও মোতালেব হোসেন। এ যুদ্ধের পর পাকসেনা ও রাজাকারেরাও মরণ কামড় দেয়। ৭ নভেম্বর পাকসেনা ও রাজাকারেরা পাল্টা আক্রমন চালায় ভাটপিয়ারী গ্রামে। এদিন ওই গ্রামের অন্তত ৭ জনকে তুলে এনে হত্যা করা হয় যমুনা পাড়ের চিথুলিয়া গ্রামে। ১১ নভেম্বর হাÐিয়াল-নওগাঁয় অবস্থান নেওয়া পলাশডাঙ্গার ওপর হামলা চালায় পাকসেনা ও রাজাকারেরা। জনগণের সহযোগিতায় এখানে এক কোম্পানি পাকসেনা এবং বিপুল সংখ্যক রাজাকারকে পরাজিত করে মুক্তিযোদ্ধারা। তাদেরকে গণপিটুনি দিয়ে একজন ক্যাপ্টেনসহ ১২ জনকে মুক্তিযোদ্ধার হাতে হস্তান্তর করে জনগণ।
এ পরিস্থিতিতে পাকসেনারা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটাতে থাকে। এতে বড় বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠা পলাশডাঙ্গার লুকিয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। পাশাপাশি চলনবিলে পানি কমে যাওয়ায় নৌকা ছেড়ে ডাঙ্গায় নামতে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। পলাশডাঙ্গার বড় বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করতে গিয়ে দল-বিচ্ছিহ্ন হয়ে পড়ে অনেকেই। অপরদিকে গুলি কমে যাওয়ায় এলাকা ছেড়ে কুড়িগ্রামের রৌমারীতে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পলাশডাঙ্গা। তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তারা রৌমারী পৌঁছে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মোজাফ্ফর হোসেন মোজামের নেতৃত্বাধীন প্রায় দেড় শ’ মুক্তিযোদ্ধার একটি গ্রæপ ১৪ নভেম্বর অবস্থান করছিল কাজীপুর থানার গান্ধাইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে। খবর পেয়ে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা ও রাজাকার হামলা চালায় ওই ্গ্রামে। এদিন গ্রামের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। পাকসেনারা ওই গ্রামে দেড় শতাধিক সাধারন মানুষকে হত্যা করে। পুড়িয়ে দেয় সহ¯্রাধিক বাড়িঘর। এদিন পাকসেনা ও রাজাকারদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহিদ হন তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। হামলা পাল্টা হামলায় ‘হয় মারো অথবা মরো’ এমনি একটা সাজ সাজ রব পড়ে যায় উভয় পক্ষের মধ্যে। গ্রাম থেকে হয় আত্মসমর্পণ অথবা পলায়ন করতে শুরু করে স্বাধীনতা বিরোধীরা। শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, বেলকুচির বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ মিলিত হয়ে ২৪ নভেম্বর হামলা চালায় চৌহালী থানার প্রধান ক্যাম্প মালিপাড়ায়। তারা ঘন্টা খানেক গোলাগুলি করে পিছিয়ে আসে। এতে পাকসেনা ও রাজাকারেরা ক্যাম্প ছেড়ে বেলকুচি হয়ে সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শহরের দিকে রওনা হয়। এভাবেই প্রথম মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানা। রায়গঞ্জ থানায় অবস্থান করছিল থানার কিছু বাঙালি পুলিশ ও রাজাকার। ২৮ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রæপ মিলে হামলা চালায় রায়গঞ্জ থানায়। তুমুল গোলাগুলির এক পর্যায়ে শহিদ হন রায়গঞ্জের হোড়গাতী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আহমদ আলী। গুলি শেষ হয়ে যাওয়ায় পিছিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধারা। ৩ ডিসেম্বর ভোর রাতে কাজীপুর থানায় হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি গ্রæপ। এদিন কাজীপুরের মুক্তিযোদ্ধা চাঁদ মিয়া পুলিশ-রাজাকারের হাতে ধরা পড়েন। থানায় নিয়ে তাকে হত্যা করা হয় নির্মমভাবে। অপরদিকে আহত হন অন্তত চারজন, তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শহিদ হন কামারখন্দের তোজাম্মেল হক। পরের দিন কাজীপুর থানার পুলিশ ও রাজাকারেরা থানা ছেড়ে রওনা হন সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে। মুক্ত হয় কাজীপুর থানা। মুক্তিযোদ্ধারা ভাটপিয়ারীর ক্যাম্প বিধ্বস্ত করে দেওয়ার পর পাকসেনার তাদের নিরাপত্ত¡ার প্রয়োজনে বাঙালি পুলিশ, মিলিশিয়া ও রাজাকারের সমন্বয়ে খোকসাবাড়ির শৈলাবাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ৯ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রæপ হামলা চালায় শৈলাবাড়ি ক্যাম্পে। এদিন শহিদ হন মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাহমুদ। অপরদিকে, বিপুল সংখ্যক এফএফ মুক্তিযোদ্ধা সীমান্ত এলাকা থেকে রৌমারী মাইনকারচর হয়ে এবং রৌমারী ইয়থ ক্যাম্পে অবস্থানরত বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন ভুলু, ইসমাইল হোসেন, জহুরুল ইসলাম তালুকদার মিন্টুর নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী হয়ে চলে আসে সিরাজগঞ্জে। রৌমারী-মাইনকারচর থেকে আসা এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করে শৈলাবাড়ি হামলা চালানোর। কারণ, শৈলাবাড়ি ক্যাম্প তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই সিরাজগঞ্জ মুক্ত করা সম্ভব। মুক্তিযোদ্ধারা পরিকল্পনা করে শৈলাবাড়ি ক্যাম্পে আক্রমন করার এবং ১২ ডিসেম্বর বিকেলে শৈলাবাড়ি ক্যাম্প হামলা চালায় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলে উভয় পক্ষে। যুদ্ধ চলাকালে কাজীপুরের দৈওল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেন এবং সিরাজগঞ্জের বহুলী ইউনিয়নের আব্দুস সামাদ শহিদ হন। শহিদদের মরদেহ নিয় পিছু হটে মুক্তিযোদ্ধারা।
অপরদিকে সম্ভবত ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা জানতে পারে যে পাকসেনাদের একটি গ্রæপ সিরাজগঞ্জের দিকে যাওয়ার খবর পায়। এসময় সিরাজগঞ্জের পান্না-শাজাহান তারা গ্রæপ, বেলকুচির নজরুল গ্রæপ এবং টাঙ্গাইলের হাবিব গ্রæপ অ্যাম্বুশ করে শমেশপুরে। পাকসেনাদের যাওয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। পাল্টা গুলি করে পাকসেনারা। শমেশপুর যুদ্ধে শহিদ হন টাঙ্গাইলের হাবিব গ্রæপের কমান্ডার হাবিবুর রহমান। ১৩ ডিমেম্বর ভোরে শৈলাবাড়ি ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় পাকিস্তান পক্ষের পুলিশ ও রাজাকার। বিভিন্ন গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে চলে গেছে। তখন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ বিচ্ছিহ্নভাবে যেতে শুরু করে সিরাজগঞ্জের দিকে। সবচেয়ে অগ্রগামী ইঞ্জিনিয়ার আহসান হাবীব গ্রæপ পৌছে যায় রাণীগ্রাম-ঘুরকার ওয়াপদা রেলক্রসিংয়ে। এসময় জমদূতের মতো একটি গ্রæপ বেড়িয়ে আসে বাঙ্কার থেকে, আক্রমন চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। যুদ্ধে কমাÐার আহসান হাবীব সহ অন্তত ৬ জন শহিদ হন। আহতাবস্থায় পাকিস্তানিদের হাতে আটক হন আকতারুজ্জামান নেহাল। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের সিরাজগঞ্জ মুক্ত করার আকাঙ্খা আর পূরণ হয়না সেদিন। ওইদিন সিরাজগঞ্জ শহরের কালীবাড়ি গ্যামন্সের (ওয়াপদা অফিস) অফিসে জড় হতে থাকে পাকসেনারা। তারা গুরুত্বপূর্ন কিছু ব্যক্তি এবং পথপ্রদর্শক ছাড়া বাঙালি পুলিশ, রাজাকার ও অন্যান্যদের বিদায় করে। রাতের আঁধারে পাকসেনারা কতিপয় সহয়োগিকে নিয়ে রায়পুর রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনে ওঠে। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা যারা তক্কে তক্কে ছিল কালিয়াহরিপুর ব্রিজের কাছে এসে অবস্থান নেয় এবং ব্রিজটি ভেঙ্গে দেয়। ফলে পাকসেনাদের স্বাভাবিক যাত্রা ব্যহত হয়। ট্রেন থেকে নেমে তারা ডাবল মার্চ করে জামতৈল কামারখন্দ হয়ে অবস্থান নেয় উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের পাশে এলএসডি গুদামের পাকসেনা ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে অবস্থান করতে থাকা রংপুর বগুড়া থেকে আসতে থাকা পাকসেনাদের। সেখানে অবস্থানরত পাকসেনারা ওই সময় নগরবাড়ি-বগুড়া রোড আগলে রাখে। এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন থানা থেকে পুলিশ ও রাজাকারেরা পালিয়ে যেতে থাকে। রায়গঞ্জ থানায় অবস্থানরত বাঙালি পুলিশ ও রাজাকারেরা আত্মরক্ষার্থে ওসি মতিউর রহমান (রাজশাহী) সহ অন্যরা থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। একই ভাবে পালিয়ে যায় উল্লাপাড়া থানার পুলিশ রাজাকার ও অন্যন্য কর্মচারিরাও। অপরদিকে, ১৬ ডিসেম্বর রাতে উল্লাপাড়া এলএসডি গুদামে অবস্থানরত পাকসেনারা কোথাও কোথাও গাড়িতে কোথাও কোথাও ডাবল মার্চ করতে করতে এসে জড় হয় শাহজাদপুরে। রাস্তায় রাস্তায় তাদের বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ভারি অস্ত্র থাকায় তাদের বাঁধা দিতে ব্যর্থ হয় মুক্তিযোদ্ধারা। শাহজাদপুর হয়ে বাঘাবাড়ি হয়ে লঞ্চ যোগে পাকসেনারা চলে যায় ঢাকা। মুক্ত হয় পাবনার জেলার অন্তর্গত সিরাজগঞ্জ মহুকুমা। পাকসেনাদের সঙ্গে নিচ্ছিহ্ন হয়ে যায় পাকিস্তান পাকিস্তানি প্রশাসনও। প্রশাসনের সে শূণ্যস্থান পূরণ করে বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধারা।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা। আহŸায়ক, সিরাজগঞ্জের গণহত্যা অনুসন্ধান কমিটি।