দেশের রাজধানী শহরে ৩০ কিমি গতিতে চলার বাহন আবিষ্কার করছে সেই দেশের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ! রিকশার নতুন নকশা করেছে বুয়েট, ‘চলবে’ ঢাকায় / বুয়েট নির্দেশিত ব্যাটারি রিকশা নামানোর চিন্তা /- এই জাতীয় সংবাদ শোভা পাচ্ছে রবিবার ২৭ এপ্রিলের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক। যেকোন আবিষ্কার দেশের জন্য সন্মান বয়ে নিয়ে আসে। এই দিগ্বিজয়ী ‘ আবিষ্কার ‘ এর পর ইউনুস রাজনৈতিক নিয়োগ ও এই প্রকল্পে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। রিকশার নতুন নকশা হিসাবে যা প্রচার করা হচ্ছে তা নতুন কোন নকশা নয়। ঢাকাতে প্রচলিত বেবিট্যাক্সি এবং CNG অটোরিকশার নতুন সংস্করণ মাত্র। প্রকৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই নকশা নিম্নমানের এবং নকল মেধা।
১৯৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাজারের মিশুক নামে তিন চাকার যানবহন প্রশংসিত হয়েছিল। তুলনামূলক কম বায়ু দূষণের জন্য মিশুক প্রসংশিত হয়েছিল। বুয়েটে থেকেই মিশুকের নকশা তৈরী হয়েছিল। তখনো মিশুক নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। আজকের নতুন ডিজাইনের ‘চলবে’ এবং মিশুকের মৌলিক ডিজাইনের কোন পার্থক্য নেই। মিশুকের চেয়ে ‘ চলবে ‘ আকারে সামান্য বড় । সেই সময়ের জনপ্রিয় যানবহন বেবিট্যাক্সসির রূপান্তর। বড়। নতুন নকশার ‘ চলবে ‘ তে যুক্ত হয়াছে কিছু বাড়তি নিরাপত্তা। নতুন রিকশায় ‘লুকিং গ্লাস’ ও ‘ইন্ডিকেটর’ থাকবে। নতুন রিকশায় সর্বোচ্চ গতি ওঠানো যাবে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার।এর তিনটি চাকায় ‘হাইড্রোলিক ব্রেক’ । বুয়েটের উদ্ভাবক / নকশাকার কি বলতে পারবেন রিক্সার কোন অংশটা নতুন আবিস্কার? তৎকালীন মিশুক কোন নতুন ডিজাইন ছিল না। সেই সময়ের জনপ্রিয় যানবহন বেবিট্যাক্সসির রূপান্তর। বুয়েটের নতুন নকশার ‘ চলবে ‘ নিতুন কিছু নয়। CNG / মিশুকের নকল বা নতুন সস্করণ। ঢাকা – চট্টগ্রাম সহ সারাদেশের নগরের ভিতরের যানবাহন ব্যাবস্থা একটি লেজে গোবরে । জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে , নতুন কর্ম সংস্থানের অভাব এই সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। শুরুতে ঢাকাতে রিক্সা ছিল এই সংকটের মূল। প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে রিক্সা রূপান্তরিত হয়েছে ব্যাটারি চালিত আটো রিক্সায়। চীন থেকে আমদানি করা ইজিবাইকের অনুকরণে রিকশায় মোটর ও ব্যাটারি যুক্ত করা শুরু হয়। রিকশায় মোটর ও ব্যাটারি যুক্ত করা হয়েছে সম্পূর্ণ স্থানীয় মিস্ত্রিদের দ্বারা।
ব্যাটারি গতি দিতে সক্ষম হলেও নিরাপত্তা ত্রুটি রয়েছে রিকশায় । ব্যাটারি চালিত আটো রিকশাকে নিরাপদ যান হিসাবে গড়ে তোলার সম্ভবনা নেইবা কম। আবার এই নিয়ে দেশের শিক্ষিত প্রকৌশলীরা তেমন কোন আগ্রহ দেখাননি। কারণ ব্যাটারি চালিত রিক্সার প্রযুক্তিগত পরিবর্তন থেকে মোটা অংকের টাকা বানানোর সম্ভবনা কম। অটো পাশাপাশি রয়েছে সিএনজি – বেবিট্যাক্সি ও একই জাতীয় তিন চাকার যানবাহন। এত বিশাল সংখ্যক যান বাহন একটি নগরের পক্ষে বহন সম্ভব নয়। এর বাইরে দুনিয়ার সকল বড় -বড় শহরের মত ঢাকাতে যুক্ত হয়েছে উবার বা এই জাতীয় রাইড শেয়ার যানবাহন। অটো রিক্সা/ রিক্সা সিএনজি / বেবিট্যাক্সি জাতীয় চালক পেশায় কয়েক লাখ মানুষের জীবন চলে।গ্রামের বেকার, অদক্ষ যুবকরা কাজের সন্ধানে ঢাকা সহ বড় শহর গুলোতে এসে কাজ না পেয়ে রিক্সা চালনাকে কাজ হিসেবে বেঁচে নিতে বাধ্য হয়। বেকার যুবকরা প্রাথমিকভাবে রিক্সা চালক হওয়াকে সাময়িক পেশা হিসেবে নেয়।
ঢাকার ব্যাটারি চালিত আটো রিক্সা গুলো ‘অবৈধ ‘ । সরকার কোন অনুমতি দেয়নি। গত ১০/১১ বছর রিকশার কোন অনুমোদন দিচ্ছে না। লাখ লাখ -লাখ অটো রিক্সা অনুমোদন বিহীন ভাবে চলা সরকারের ব্যার্থতা।
ব্যাটারি চালিত আটো রিকশার সঠিক সংখ্যা অজানা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম বিভিন্ন সংখ্যা উল্ল্যেখ করে আসছে। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আসছে। এই সংখ্যা ১০/১২ লাখ হতে পারে। তবে যে হরে নতুন নতুন ব্যাটারি চালিত রিক্সা রাস্তায় নামছে , তা পরিসংখানে নিলে ২/৪ বছরের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় প্যাডেল চালিত রিক্সা থাকবে না। ঢাকাতে যানবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়ার সাথে যুক্ত রয়েছে লাখ- কোটি টাকার বাণিজ্য। ‘২০০৩ সালে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালুর আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রায় এক লাখের মতো মিশুক-বেবিট্যাক্সি চলাচল করত। সেগুলো তুলে দিয়ে দুই শহরে ২৭ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা নামানো হয়। তখন অটোরিকশার অনুমতিপত্র বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে।’ ‘বিআরটিএর নিবন্ধন পাওয়া প্রতিটি অটোরিকশা এখন হাতবদল হয় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায়।’ মিশুকে কেনইবা অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল , আবার কেনইবা অনুমোদন বাতিল করা হলো এই সবের জবাবদিহিতার কোন সংস্কিতি দেশে গড়ে উঠেনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ সমকালকে বলেন, ‘ঢাকার সড়কে এখন যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে, সেগুলো থাকবে না। বুয়েট আমাদের ব্যাটারিচালিত রিকশার একটি নকশা তৈরি করে দিয়েছে। এটি নিয়ে মঙ্গলবার ব্যাটারিচালিত রিকশা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছি। বুয়েটের নকশা অনুযায়ী তাদের রিকশা তৈরি করতে বলা হয়েছে।’ কোন প্রতিষ্টানকে নকশা দেওয়া ও তৈরী করতে বলা কোন সিটি করপোরেশনের এক্তিয়ার ভুক্ত নয়। কোন নকশার আসার সাথে সাথে অতি দ্রুত গতিতে কোন একটি ‘ নিদৃষ্ট ‘ সংস্থাকে যাচাই বাছাই ছাড়া বুয়েটের নকশা অনুযায়ী রিকশা তৈরি বলা হলো ?
ইউনুস সরকার নতুন নকশার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ৩০০ জন মাস্টার ট্রেইনার নিযুক্ত করার সিদ্বান্ত নিয়েছে । সরকারি ভাষ্যানুযায়ী যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণকারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার করা হবে। অর্থাৎ ৩০০ মানুষ রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকুরী পাচ্ছে ! এখানে প্রশ্ন হচ্ছে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ কাজ কি হবে ? ইউনুস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ব্যাটারি চালিত রিকশার উপরে আক্রমন হচ্ছে। ২৯ নভেম্বর ২০২৪ সালে হাইকোর্ট ব্যাটারি চালিত বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। পরে প্রতিবাদের মুখে সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ছাত্রদেরকে রিকসা চালকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় । শ্রমিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ঘৃনা ছড়ানোহয় সামাজিক মাধ্যমে। ব্যাটারি রিক্সা , আনসার , গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনকে আওয়ামীলীগ -ছাত্রলীগ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার সুস্পষ্ট অপচেষ্টা দৃশ্যমান ছিল । সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে ব্যাটারি রিক্সার বিকল্প হিসাবে বিভিন্ন ধরণের তিন চাকার গাড়ি নেমেছে। এই যানবাহন গুলো গুনে মানে ব্যাটারি রিক্সার চেয়ে ভাল। লাখ লাখ ব্যাটারি রিকশার উচ্ছেদ নতুন ধরণের তিন চাকার গাড়ির বাজার তৈরির পথকে সুগম করে দিবে। ব্যাটারি উচ্ছেদের কারণ হিসাবে যানজট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলা হলেও ভিতরে কি কোন এক গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার খেলা হচ্ছে। বুয়েটের উদ্ভাবিত নতুন রিকশায় সাথে বাজারে প্রচলিত আটো রিকশার প্রধান পার্থক্য হচ্ছে ব্রেক সিস্টেম। শিক্ষিতরা এগিয়ে আসলে ব্যাটারি চালিত রিকশায় উদ্ভাবিত রিকশার ব্রেক ব্যাবহার করা সম্ভব। পরিকল্পিত ভাবে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ যানবাহনে উত্তরণ সম্ভব।
—
সহায়ক তথ্য সূত্র :
১. রিকশার জঞ্জাল রাজধানী। ৪ নভেম্বর ২০২৪। মানব জমিন।
২. সিএনজিচালিত অটোরিকশা সেবায় নৈরাজ্য জিইয়ে রাখতে আন্দোলন, জিম্মি নগরবাসী। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫। প্রথম আলো।
৩. ৪ লাখ টাকার গাড়ির কাগজের দামই ১৪ লাখ। ২২ জুন ২০১৯। প্রথম আলো।
৪. বুয়েট নির্দেশিত ব্যাটারি রিকশা নামানোর চিন্তা। ২৩ এপ্রিল ২০২। প্রথম আলো।