২৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের চৌহালীর মালিপাড়া অভিযানের মধ্যে দিয়ে সিরাজগঞ্জে শুরু হয় পাকিস্তানিদের পরাজয়। একের পর এক আক্রান্ত হতে থাকে পাকসেনা, পাকিস্তানি পুলিশ ও রাজাকারদের ক্যাম্প। কাজীপুর আক্রান্ত হলে ৪ ডিসেম্বর থানা থেকেও চলে আসে পাকিস্তানি থানার ওসিসহ পুলিশ ও প্রশাসন। ফলে সেটি দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ১০ ডিসেম্বরে শৈলাবাড়ি ক্যাম্প থেকে মিলিশিয়া বাহিনী এবং ১৩ ডিসেম্বরে পুলিশ ও রাজাকারদের প্রত্যাহার করা হয়। খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জ শহরে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় মুক্তিযোদ্ধারা। ও্ই রাতেই পাকসেনা সিরাজগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে ট্রেন যোগে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু এ সময় কালিয়াহরিপুর রেলব্রিজ ভেঙ্গে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে তারা জামতৈল হয়ে পায়ে হেঁটে উল্লাপাড়া রেল স্টেশনের পাশে এলএসডি গুদামে স্থাপিত পাকসেনা ক্যাম্পে অবস্থান নেয়।
সিরাজগঞ্জ থেকে পাকসেনা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে বিভিন্ন থানায় অবস্থানরত ওসির নেতৃত্বাধীন পুলিশ ও রাজাকার এবং সিওর নেতৃত্বাধীন বেসামরিক প্রশাসন ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে, তারা পালিয়ে যায় সরকারি দফতর ছেড়ে। ১৭ ডিসেম্বর শাহজাদপুর মুক্ত হওয়ার মধ্যে দিয়ে মুক্ত হয় পুরো সিরাজগঞ্জ মহুকুমা। আমির হোসেন ভুলু সিরাজগঞ্জ কলেজ হোস্টেলে, ইসমাইল হোনেস (দোয়াতবাড়ি) ভিক্টোরিয়া স্কুলে, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী কওমী জুট মিল, খম আকতার, বাসেত মাস্টার, ফজলুল মতিন মুক্তারা ইসলামিয়া কলেজ, ইসমাইল হোসেন (রহমতগঞ্জ) স্পিনিং মিল, তৌহিদ পানারা সিও অফিস, লতিফ মির্জার নেতৃত্বাধীন পলাশডাঙ্গা মোক্তার পাড়ার সাহারা হোটেল, এফএফ গ্রæপ জ্ঞানদায়িনী স্কুলে অবস্থান নেয়। ন্যাপ মোজাফ্ফর গ্রæপের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মাড়োয়ারি পট্টিস্থ অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ সময় সিরাজগঞ্জ মহুকুমা প্রশাসনে এসডিওর দায়িত্ব পালন করছিলেন এএম আলিমুজ্জামান এবং মহুকুমা পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করছিলেন আব্দুল জব্বার।
মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনে তারা ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন থানা ইউনিয়নে গড়ে তোলা হয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প। রায়গঞ্জ থানায় প্রধান দুটি ক্যাম্প স্থাপিত হয় ধানগড়া থানা ও নিমগাছীতে। থানা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন শেখ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন এবং নিমগাছী ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন আব্দুর মান্নান ওরফে কবি সমুদ্র গুপ্ত। উল্লাপাড়া থানায় ক্যাম্প করেন পলাশডাঙ্গার খোরশেদ আলী। উল্লাপাড়ার মোহনপুরে ক্যাম্প করা হয় শম আব্দুল ওয়াহাবের নেতৃত্বে। শাহজাদপুর থানায় ক্যাম্প করেন খালেকুজ্জামান। উল্লাডাবের আব্দুল হাই তার বাহিনী নিয়ে ক্যাম্প করেন বেলতৈল ইউনিয়নের ঘোরশালে। মির্জা আব্দুল বাকী খোকন ক্যাম্প করে শাহজাদপুর কলেজে। আতিকুল ইসলাম বাকী ক্যাম্প করেন বেলকুচি থানায়। ১৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের বাহিরগোলা পাওয়ার হাউজে ‘বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা’দের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘প্রশাসন পূনর্গঠন কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। এই কাউন্সিলের সদস্যরা হলেন আমির হোসেন ভুলু, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুল লতিফ মির্জা, ইসহাক আলী, ইসমাইল হোসেন (দোয়াতবাড়ি), ইসমাইল হোসেন (রহমতগঞ্জ) প্রমুখ। বৈঠকে আমির হোসেন ভুলুকে মুহুকুমা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক এবং আব্দুল লতিফ মির্জাকে সহ-সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। বেসমারিক প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসমাইল হোসেন (দোয়াতবাড়ি)-কে। তারা সিরাজগঞ্জ কলেজ ও ভিক্টোরিয়া স্কুল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে অবস্থান করে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী সিরাজগঞ্জবাসীর কাছে এ দুইজন এসডিপিও এবং এসডিও হিসেবে পরিচিত হন।
প্রশাসন পূনর্গঠন কাউন্সিল থেকে সিরাজগঞ্জ থানা প্রশাসক হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম কিবরিয়া এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস যথাক্রমে সিরাজগঞ্জ সদর ও কামারখন্দ থানার দায়িত্ব পান। কাজীপুর থানার দায়িত্ব পান বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান দুদু। একই ভাবে রায়গঞ্জ থানা শেখ মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, তাড়াশ থানায় আমজাদ হোসেন মিলন ও ইসহাস আলী, বেলকুচি লুৎফর রহমান মাখন, চৌহালী নওশের আলী মাস্টার, উল্লাপাড়া থানার খোরশেদ আলম দায়িত্ব পান। পাশাপাশি উল্লাপাড়া উন্নয়নের দায়িত্ব পান আব্দুল আজিজ মির্জা। শাহজাদপুর থানা প্রশাসকের দায়িত্ব পান আব্দুল বাকী মির্জা খোকন। একই থানায় খাদ্য ও শিক্ষার দায়িত্ব পান শাহেদুজ্জামান হেলাল। একই ভাবে বিভিন্ন ইউনিয়নে পাকসহযোগি চেয়ারম্যানগণ মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ে পালিয়ে যায়। ফলে সেখানেও এক ধরণের শুণ্যতা বিরাজ করতে থাকে। শুণ্যতা পূরণে প্রতিটি ইউনিয়নে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়। সিরাজগঞ্জে ইউনিয়ন রিলিফ কমিটিÑ ইউনিয়ন রিলিফ কমিটির সভাপতিরা হলেনÑ রতনকান্দি ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ তালুকদার (চিলগাছা), মেছড়া ইউনিয়নে আব্দুল কুদ্দুস তালুকদার (খামারপাড়া), বাগবাটী ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব আলী (পিপুলবাড়িয়া), শিয়ালকোল ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ নেতা মহির সরকার, কালিয়াহরিপুর ইউনিয়নের আব্দুল মালেক সরকার (কালিয়া)। কামারখন্দ বিভিন্ন ইউনিয়ণ রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যানÑ জামতৈল ইউনিয়নে আলী আজহার তালুকদার, রায়দৌলতপুর ইউনিয়নে আয়নাল ভূঁইয়া, ঝাঐল ইউনিয়নে আকবর হোসেন (বড়ধুল)। এভাবেই সিরাজগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়নে রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এই চেয়ারম্যানগণ হন মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ। কামারখন্দ থানা থানা আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধা বিমল কুমার দাস ক্যাম্প স্থাপন করেন স্থানীয় সিও অফিসে। তিনি জানান, ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কিছু রাজাকারকে আটক করে।
কোনও কোনও রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য স্বেচ্ছায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাদের আটক রাখা হয় থানা হাজতে। এসব রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাঘাট মেরামত করা হয়। ক্যাম্প থেকে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন ইউনিয়নে পাঠানো হয়, উদ্দেশ্য যুদ্ধ চলাকালে লুট হওয়া মালামাল উদ্ধার। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কিছু মালামাল উদ্ধার করে মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসণের ব্যবস্থাপনায় কওমী জুট মিল চালু করা হয়। চালু করা হয় বিভিন্ন স্কুল কলেজ। ন্যাশলাল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে কওমী জুট মিল শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরী ও বেতন এবং বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বেতনের ব্যবস্থা করা হয়। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্ত¡া দিতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ট্রেন যোগাযোগ চালু হলে স্টেশনে স্টেশনে বক্তৃতা মুক্তিযোদ্ধারা বিনা টিকিটে ভ্রমনকারী যাত্রীদের টিকিট কাটতে উদ্বুদ্ধ করে। গ্রামে গ্রামে ক্লাব, পাঠাগার, স্কুল, সমবায় সমিতি গড়ে উঠতে থাকে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে এভাবেই শুরু হয় উন্নয়নের জোয়ার। এদিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে সিরাজগঞ্জের নিউ মার্কেটে। সেখানেই মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। অপরদিকে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যেই সিরাজগঞ্জে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রæপের কাছে থেকে অস্ত্র জমা নিতে থাকে। যে সব মুক্তিযোদ্ধা চাকুরি পেতে আগ্রহী তারা মিলিশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি হতে থাকে। আর ছাত্র মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়ে তাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যেতে থাকে। সরকার থেকে ‘সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার কাজে ফিরে যাওয়ার’ নির্দেশ জারি হতে থাকে। অপরদিকে বদলীর হুকুম নিয়ে চলে আসতে থাকে প্রশাসনের লোকজন। যারা আসতে থাকে তারা অবশ্যই বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগকৃত কর্মচারী। ফলে কোনও প্রশ্নই ওঠে না মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তারা প্রশাসন চালু করতে থাকে। অবশেষে, ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে বিএলএফের ৪ যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহম্মদ তাদের যুদ্ধকালীন অস্ত্র তুলে দেন। অন্যান্ন অঞ্চলের মতো সিরাজগঞ্জেও সমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব।
সমাপ্ত।