এক
প্রফেসর ইউনূসের জাপান সফর করছেন। বিদেশ সফর ও বিদেশিরা আমাদেরকে কতটুকু সমাদর করছে এ নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে আদিখ্যেতা রয়েছে। দেশের শাসক গোষ্ঠী ও ক্ষমতার সুবিধাভোগী রাজনৈতিক গোষ্ঠী, গণমাধ্যম বিদেশ সফর নিয়ে নানান গল্প ফাঁদে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রায় ২১ লাখ লোক কর্ম হারিয়েছেন। বেকারত্বের পশ্চাদভূমি বাংলাদেশের বর্তমানের লোভনীয় গল্প হচ্ছে ‘জব ‘ ! ভদ্রলোকদের মুখে বাংলা খুব আসে না। চাকুরী বা কর্ম সংস্থান এর চেয়ে ‘ জব ‘ তা একটি ভারিক্কি শোনায় বৈকি। ইউনূসের প্রচার মাধ্যম দাবি করছে আগামী পাঁচ বছরে জাপানে এক লাখ শ্রমিক রফতানির একতরফা ঘোষণা এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। ৫ বছরে ১ লাখ ! সংখ্যাটি তেমন বড় কিছু নয়। বছরে ২০ হাজার শ্রমিক। মুহাম্মদ ইউনূস জাপানের ‘জব ‘ সৃষ্টির পিছনে জাপানি সরকারের কোন সুনিদৃষ্ট আশ্বাস বা প্রস্তাব নেই। ইউনুস জাপানের ২/৩টি বেসরকারি সংস্থার সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করছেন মাত্র। এই জাতীয় সমঝোতা স্বাক্ষরের কোন আইনি বাধ্যকতা নেই। ১৯৯০ দশক থেকে জাপানে গড়ে ২০ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থান হচ্ছে ব্যাক্তিগত উদ্যোগে। জাপানে ২০১৭ সাল থেকে কারিগরি শিক্ষানবিশ হিসেবে কর্মী যাচ্ছেন। দৈনিক সমকাল ২৯ মে ২৫ ইউনূসের সফর সম্পর্কে লিখছে ” সেমিনারে প্রধান উপদেষ্টা দুটি সমঝোতা স্মারকের সাক্ষী হন। প্রথমটি বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি) ও কাইকম ড্রিম স্ট্রিট (কেডিএস)-এর মধ্যে, যার একটি জাপান-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগ; দ্বিতীয়টি বিএমইটি ও জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-soঅপারেটিভস (জাপানে ৬৫টির বেশি কোম্পানির একটি ফেডারেশন) এবং জেবিবিআরএ (জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি)-র মধ্যে। ”
দুই
প্রফেসর ইউনূসের জাপান সফর প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নিক্কেই ফোরামের ৩০তম ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ’ সেমিনারে যোগ দেওয়া। এই অনুষ্টানে যাওয়াকে সামনে রেখে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কাজে লাগিয়ে জাপানি সরকারি পর্যায়ে দুই/ একটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছে ইউনুস । ডক্টর ইউনূসকে এয়ারপোর্টে বরণ করতে জাপানের সরকারি পর্যায়ের একজন অফিসিয়ালকেও বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় নি। কারণ ড. ইউনূস জাপান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে গিয়েছেন জাপানে । নিক্কেই ইনকর্পোরেশনের মালিকানাধীন অর্থনৈতিক পত্রিকা নিক্কেই এশিয়ার উদ্যোগে ‘ফিউচার অব এশিয়া’সম্মেলনে বক্তৃতা করতে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছেন। বাংলাদেশের সরকারি অর্থে তিনি জাপানে বেসরকারি আয়োজনের একটি সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন । ব্যাক্তিগত কাজে সরকারি অর্থ অপচয়কে জায়েজ করতেই রিক্রুটিং এজেন্সি বা জাইকার সাথে মিটিংকে বড় করে প্রচার করছে ইউনুস সরকার। রিক্রুটিং এজেন্সি বা জাইকার সাথে মিটিং একজন সচিব পর্যায়ের কাজ।
১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর আয়োজিত হয়ে আসা ‘ফিউচার অব এশিয়া’ ফোরাম একদিকে যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও একাডেমিক নেতৃত্বের মিলনমেলা। অন্যদিকে তেমনি এটি একটি কৌশলগত মতবিনিময় ও দৃষ্টিভঙ্গি ভাগাভাগির মঞ্চ হিসেবে বিবেচিত। এবারের সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা, অর্থনীতিবিদ, বিশ্লেষক এবং ব্যবসায়িক নেতৃত্ব। বিশ্ব বর্তমানে এক যুগান্তকারী মোড়ে দাঁড়িয়ে। ২০২৪ সালে বিশ্বের বহু দেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন, যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্রাম্প শুল্ক’-এর পুনরায় প্রবর্তন, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি এবং মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও ভূমিকম্প-পরবর্তী মানবিক সংকট—এসব ঘটনাপ্রবাহ গোটা এশিয়াকে এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে । এই প্রেক্ষাপটে নিক্কেই ফোরামের রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। জাপানের রাজধানী টোকিওতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘ফিউচার অব এশিয়া’, যা এ বছর উদ্যাপন করছে এর ৩০তম বার্ষিকী। জাপানের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক সংবাদমাধ্যম Nikkei Inc. কর্তৃক আয়োজিত এই ফোরামটি চলমান বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক শান্তি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রত্যয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
নিক্কে – Nikke একটি সংবাদ পত্র। নানান বিবর্তনের মাধ্যমে Nikke আজকের এই অবস্থানে এসেছে। Nikke এর পূর্বসূরি পত্রিকার যাত্রা শুরু ১৮৭৬ সালে। ১৯৪৬ সালে এটি Nihon Keizai Shimbun নামে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে Nikkei দৈনিক প্রায় ৩০ লক্ষ কপি প্রচার করে, যা একে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক সংবাদপত্রগুলোর কাতারে দাঁড় করিয়েছে। ২০১৫ সালে Financial Times অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে Nikkei তার আন্তর্জাতিক অবস্থান আরও শক্তিশালী করে তোলে।
তিন
ইউনুস একজন ব্যাবসায়ী। একজন উদ্যোক্তা। সবাইকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে থাকেন। যে কোন ব্যাবসার মূল বিষয় হচ্ছে দিন শেষে ফলাফল কি দাঁড়ালো। জমা-খরচের খাতায় কি জমা হলো। কয়েকটি রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে সমঝোতা স্মরক আর উচ্চ সুদ, প্রযুক্তিগত ঘাটতির গ্যাস মিটার কেনার চুক্তি ছাড়া কোন কিছু নেই এই সফরে। পুরানা গ্যাস মিটার কেনার চুক্তির উপর দৈনিক সমকাল প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ” পুরোনো প্রযুক্তির গ্যাস মিটার গছিয়ে দিচ্ছে জাপান।” জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের এক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, তিতাসসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান এ মিটার নিতে চাইছে না। জাপান জোর করে পুরোনো প্রযুক্তির এসব মিটার চাপিয়ে দিচ্ছে। সচরাচর মেয়াদোত্তীন প্রযুক্তির কেনার সাথে জড়িয়ে সেই দেশের রাজনৈতিক প্রচ্ছন্ন সমর্থন। এই সমর্থনের প্রধান কারণ হচ্ছে বিনিয়োগ কৃত অর্থের ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা। বিষয়টি ক্রেতা দেশর ক্ষমতাসীন সরকার ও বিক্রেতা দেশ উভয়ের জন্য সোনায় সোহাগা। এই বাইরে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। শুধু মাত্র ভোক্তভুগী হচ্ছে ক্রেতা দেশের জনগণ।
পিছিয়ে পড়া প্রযুক্তির মিটার কেনার ঋণের শর্ত বিশ্বব্যাংক কিংবা এডিবির চেয়েও কঠিন। বিশ্বব্যাংক বা এডিবির ঋণ পরিষদের সাধারণ সময়কাল ২০ থেকে ৩৫ বছর। মিটার কেনার জাপানিজ রিন্ পরিশোধের সীমা মাত্র ১০ বছর। সঙ্গত কারণে ঋণের কিস্তির পরিশোধের পরিমান বেশি। ঋণ নেওয়ার ছয় মাস পরই প্রথম পরিশোধের কিস্তি শুরু। জাপান এই ঋণ দিচ্ছে কিন্তু এ ঋণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নিশ্চয়তা আনার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। আইএমএফ এর নিশ্চয়তার কারণ হচ্ছে সরকারকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তার পাশাপাশি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলেও কিস্তি যাতে সংকটে না পড়ে, সে নিশ্চয়তা বিধান। দেশে যে কোন সরকার আসুক তারা আইএমএফ এর ঋণ ছাড়া চলতে পারবে না।
জাপানিজ ঋণের সুদ ধরা হয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ থেকে ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত। সাথে ঋণে প্রতিশ্রুতি চার্জ দশমিক ৫০ শতাংশ, অগ্রিম ফি ১ দশমিক ৫ শতাংশ, এজেন্ট ফি ২০ হাজার জাপানি ইয়েনসহ সব খরচ এ ঋণ থেকে বাংলাদেশকেই দিতে হবে। সব কিছু একসাথে করলে পিছিয়ে পড়া প্রযুক্তির মিটার কেনার সুদের হার ৭ % ছাড়িয়ে যাবে। একাউন্টিং এর পরিভাষায় সুদের হার – I nterest rate এবং Effective interest rate দুটি পৃথক হিসাব রয়েছে। কাগজে কলমে কিংবা বিজ্ঞাপনে সুদের হারের সাথে অন্য সকল চার্জ যুক্ত করেই বোঝা যায় ঋণের বোঝা কত ভারী।
সহায়ক তথ্য সূত্র
১. পুরোনো প্রযুক্তির গ্যাস মিটার গছিয়ে দিচ্ছে জাপান। প্রতিবেদক: তাসনিম মহসিন ও হাসনাইন ইমতিয়াজ। দৈনিক সমকাল। ২৮ মে ২০২৫।
২. জাপানে প্রধান উপদেষ্টা -ডিসেম্বরে নির্বাচন চাইছে একটি দল। প্রথম আলো। ৩০ মে ২০২৫।
৩. ‘লিঙ্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক গবেষণা : চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে চাকরি হারিয়েছেন ২১ লাখ ৮৫ শতাংশই নারী। বণিক বার্তা। ২৭ মে ২০২৫।