বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৪ অপরাহ্ন

ইউনূসের ভাষণ: করিডোর ও চিলে কান নিয়ে যাওয়ায় দুমড়ানো সত্য বয়ান – অপু সারোয়ার

অপু সারোয়ার
রবিবার, ৮ জুন, ২০২৫

কোরবানির ঈদের ছুটি ১০ দিন। এমন একটি সময়ে ঈদের আগের রাতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণের সময় সরকারের জন্য সুবিধাজনক। সরকারের যা বলার তা বলা বলে হলো । আবার একই সাথে ঈদের আমেজ ও ডামাডোলে এই ভাষণ নিয়ে আলোচনা বা প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত থাকলো। এই বক্তব্যের আগে ৩ জন মধ্যরাতে মুক্তিযোদ্ধার নতুন সংগা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে তা থেকেও দৃষ্টি সরানো সম্ভব হলো। সব কিছুই পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত খেলা।
এই ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছু গুরুত্ব পূর্ণ কথা বলেছেন। দুই একটি মিথ্যা কোথাও বলেছেন। করিডর দেওয়ার বিষয়টি ‘সর্বৈব মিথ্যা’ হিসেবে বলেছেন। খুব ভাল কথা। দেশের মানুষ আশ্বস্ত হতে পারলো অন্ততঃ সরকারি ভাবে কোন করিডোর দেওয়া হচ্ছে না। করিডোর নিয়ে যে আলোচনা এর সব কিছুই সরকারি উদ্যোগে। ইউনূসের নিরাপত্তা উপদেষ্টা , প্রেস সচিব ও পররাষ্ট্র সচিব দফায় দফায় আলোচনা থেকে দেশের মানুষ করিডোর / ত্রাণ চ্যানেল / মানবিক প্যাসেজ ইত্যাকার বিষয় জেনেছে। ডিসেম্বর ২০২৪ বেশ শেষ সপ্তাহ থেকে মে ২০২৫ মাসের এই জাতীয় সংবাদ সবগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। নিজের পারিষদবর্গের কথাকে ‘ চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প’ হিসাবে বর্ণনা করা হচ্ছে মিথ্যাচার।
ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস জানান, জাতিসংঘের মহাসচিব গত মার্চ মাসে ঢাকা সফরকালে রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সহায়ক হবে। বিষয়টি প্রস্তাব পর্যায়েই রয়ে গেছে। এই বক্তব্য দুমড়ানো সত্য। কারো পক্ষেই জাতিসংঘের মহাসচিবকে ফোন করে ইউনূসের বক্তব্য যাচাইয়ের সুযোগ নেই। জাতিসংঘের সকল প্রস্তাব সকল সময়ে লিখিত রূপে আসে। জাতিসংঘের মহাসচিবের পদটি অলংকারিক , সমন্বয়কের। নিরাপত্তা , শিক্ষা , শরণার্থী বিষয়ক বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। এই সব বিভাগ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধি গোয়েন লুইস ঢাকায় বসেই স্পষ্ট করে বলছেন করিডোর / মানবিক চ্যানেল এর সাথে জাতিসংঘের কোন সম্পর্ক নেই। গোয়েন লুইসের বক্তব্য বুধবার ,৪ জুন ২৫ এর সকল প্রধান গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দেশের মানুষ কার কথা বিশ্বাস করবে ? ৪ তারিখের জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধি গোয়েন লুইসের বক্তব্য না ৬ তারিখের ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ ! ইউনুস জাতিসংঘের মহাসচিবকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। জাতিসংঘের বাংলাদেশ প্রতিনিধি জাতিসংঘের মহাসচিবকে প্রতিনিধিত্ব করেন , এই নির্জলা সত্যটি সামনে আনলে ইউনূসের বক্তব্য ধুলায় মিশে যায়।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘এটা চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গল্প। যারা অসত্য কল্পকাহিনি বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’ জনগণকে এ বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনোভাবেই বিভ্রান্ত হবেন না। এসব অপপ্রচার সত্ত্বেও আমরা লক্ষ্যচ্যুত হব না। এই জটিল সমস্যাটি সমাধানে আমাদের কাজ চালিয়ে যাব।’ বিষয়টি চিলে কান নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা নয়। ইউনূস সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। জনগণের প্রতিক্রিয়ায় শুধু পিছিয়ে এসেছেন মাত্র। ত্রাণ চ্যানেল / করিডোর যে নামেই বলা হোক না কেন বিষয়টি বার্মার সাথে কূটনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি করেছে। মাত্র ৬ ঘন্টার নোটিশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে বার্মা থেকে বহিষ্কারের মত ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছে।
৬ জুনের ভাষণে মুহম্মদ ইউনুস দাবি করেছেন ‘অসত্য কল্পকাহিনী বানিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’ শব্দ ও বাক্যের প্রয়োগের কৌশল ও পারঙ্গমতা থাকলেও মুহম্মদ ইউনুসের বক্তব্যে কোন সত্যতা নেই। ১৪ই ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা: বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক বিবেচনাসমূহ’ শিরোনামের একটি আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগের একটি ধারণা দিয়েছিলেন। এই আলোচনা হচ্ছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত করিডোর ও আরাকান আর্মি বিষয়ক আলোচনার প্রথম সূত্রপাত। বিবিসি বাংলার ভাষ্য মতে ‘ ফেব্রুয়ারির ২০২৫ প্রথম সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় ‘হিউম্যানিটারিয়ান চ্যানেলে’ বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রথম এসেছিলো।’ এর পর মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাখাইনের যুদ্ধবিধ্বস্ত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ও আরাকান আর্মির মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা উচিত বলে মন্তব্য করে। এর কয়েকদিন পরেই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ঢাকায় আসেন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। আটই এপ্রিল ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে খলিলুর রহমান মানবিক সহায়তা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিকল্প না থাকার কথা তুলে ধরেন। পরদিন নয়ই এপ্রিল মি. রহমানকে একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দিয়ে সরকার জানায়, এখন থেকে তার পদবি হবে ‘জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ’। এই হচ্ছে করিডোর আলোচনার শুরুর কথা।
বিবিসি বাংলার ২৮ এপ্রিল পররাষ্ট্র উপদেস্টা তৌহিদ হোসেনকে উদৃতি করে লিখেছে “এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব,” কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে, শর্ত হিসেবে বাংলাদেশ কী চেয়েছে কিংবা সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সুযোগ থাকবে কি-না এসব কিছুই সরকার প্রকাশ করেনি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে এই রকম বেশ কিছু সংবাদ ভেসে বেড়াচ্ছে। এর পরেও প্রফেসর ইউনুস বলে যাচ্ছেন ‘মানুষকে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করে অশান্তি সৃষ্টিতে নিয়োজিত, এটা তাদেরই শিল্পকর্ম।’
মুহাম্মদ ইউনূস ভাষণে বলেছেন ” রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ও সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সরকার সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ” এই মিথ্যাচারে নতুন রূপ। কোন এক দেশ যখন অন্য দেশের কূটনৈতিক বা দূতাবাসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বহিস্কার করে তখন আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশি কূটনৈতিককে বহিষ্কারের পরে কেমন করে আলোচন চলছে তা ভেবে দেখার বিষয়। আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে কোন ভাবেই আগ্রহী নয়। রোহিঙ্গা ও আকারকান আর্মি পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানে। গত ৪/৫ মাসে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে।
ভাষণে ইউনুস বলেছেন ” প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরেকটি বড় অগ্রগতি হচ্ছে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক প্রত্যাবাসনযোগ্য রোহিঙ্গাদের সর্বপ্রথম তালিকার ঘোষণা। গত এপ্রিল মাসে ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে আলোচনার সময় মিয়ানমার সরকার প্রথমবারের মতো ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে।” ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া শুরু করেছে বার্মা সরকার । ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুইবার তাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ সফল হয়নি। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় ১ লাখ ৩৫ হাজার প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে ঘোষণা করেছিল।কিন্তু ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোন তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল হয়নি। কারণ মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের অভিবাসিত নাগরিক বলছে। রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমার এ ছিলো সেটা বলছে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোন পার্থক্য নেই। গত এক বছরে , ইউনুস শাসনামলে আরাকানের নিয়ন্ত্রণ আরাকান আর্মির হাতে। এই সময়ে এক লাখ রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে। এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ভেরিফাই করতে মিয়ানমারের আট বছর লেগেছে। রোহিঙ্গা আছে ১২ লাখ। সবাইকে ভেরিফাই করতে তাহলে ৪০ বছর লাগবে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ৪ মে ২০২৫ বলেছেন ” মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দেখছি না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এ বিষয়ে বাস্তব কোনো ফল আসবে না। দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির ওপর বাংলাদেশের প্রাথমিক নির্ভরতা ছিল। আমিসহ অনেকেই সতর্ক করেছিলাম যে, এই ধরণের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। বছরের পর বছর ধরে চলা দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়াটি নিরর্থক, কেননা একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা যায়নি। ” ( দৈনিক ইত্তেফাক ০৪ মে ২০২৫ ) । রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে ইউনূসের বক্তব্য আরেকটি দুমড়ানো সত্য।
——
তথ্য সূত্র:
১. ‘মানবিক করিডোর’ বিতর্ক, খোলাসা করছে না সরকার। ২০ মে ২০২৫। দৈনিক যুগান্তর।
২.’মানবিক করিডর’ নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যায় কাটেনি সন্দেহ, সংশয়। ২২ মে ২০২৫। বিবিসি নিউজ বাংলা।
৩. রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি বাংলাদেশ। ২৭ এপ্রিল ২০২৫। দৈনিক ইত্তেফাক।
৪.মানবিক করিডোর ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ২১ মে ২০২৫। ইত্তেফাক ডিজিটাল রিপোর্ট।
৫.মানবাধিকারবাংলাদেশ-রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নতুন কৌশল?৫ এপ্রিল ২০২৫। ডয়েচ এ ভ্যালি – অনলাইন।
৬. রাখাইনের জন্য করিডর বাংলাদেশের জন্য কী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে? ২৮ এপ্রিল ২০২৫। বিবিসি নিউজ বাংলা।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!