৬ জুন ২০২৫। প্রফেসর ইউনুস জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশী কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়ার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছেন। পাশাপাশি বন্দরকে ইজারা দেওয়ার বিরোধিতা করছে তাদের প্রতিহত করার আহবান জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ৮,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনালটি চালু হয় ২০০৭ সালে। দেশের মোট কন্টেইনার পণ্যের প্রায় ৫৫ শতাংশ এই টার্মিনালের মাধ্যমে ওঠানামা করে। টার্মিনালটি আধুনিক যন্ত্রপাতিসম্পন্ন ও অত্যন্ত লাভজনক—বছরে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব দেয়। দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে এনসিটির দায়িত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ইউনুস সরকার। ইউনুস নিজে ও সরকারের সাফাইকারী দল বিদেশী কোম্পানির নানান সফলতা তুলে ধরে চলছেন। এই সফলতার অন্যতম বিষয় হচ্ছে এই কোম্পানি ‘ ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বিশ্বজুড়ে বন্দর পরিচালনা করে। ‘ ইউনুস ক্যাম্পের এই তথ্যটি খণ্ডিত সত্য। যে দেশ গুলোতে ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দরের দায়িত্ব পালন করে , সেই দেশগুলোর আন্তর্জাতিক বন্দর কত গুলো এবং এর মধ্যে মধ্যে কয়টা বিদেশি কোম্পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এই তথ্য ইউনুস ক্যাম্প প্রকাশ না করেই খণ্ডিত বক্তব্য হাজির করে যাচ্ছে।
বন্দর ইজারা দেওয়াকে জনগণের কাছে বিক্রি করতে প্রফেসর ইউনুস রঙ্গিন স্বপ্ন বিক্রি শুরু করেছেন। ইউনুস বলেছেন ” তাদের [ ডিপি ওয়ার্ল্ড ] কাজ বন্দর ব্যবস্থাপনা করা, আমাদের লক্ষ্য হলো বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের কাছ থেকে শিখে নেওয়া। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, যদি ৩১ সালের মধ্যে আমরা বন্দরের কাজ শিখে ফেলি এর পরবর্তী ৫ বছরে অর্থাৎ ৩৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর যত দেশে যত বন্দর এই কোম্পানিগুলো চালায় তাদের বহু বন্দর এই বাংলাদেশিরাই পরিচালনা করবে।” অতি অবাস্তব ও বেকার জনগোষ্ঠীকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া বক্তব্য। ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দর পরিচালনা করে। ডিপি ওয়ার্ল্ড বা কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের দক্ষতা শিখিয়ে নিজেদের বাণিজ্য হাত ছাড়া করার নজির নেই। ডিপি ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশে আসছে বন্দর পরিচালনা করতে। বন্দর পরিচালনার কৌশল শিখতে নয় !
যে কোন আন্তর্জাতিক কোম্পানির সাথে চুক্তির বেশ কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ডিপি ওয়ার্ল্ড এর সাথে এর মধ্যে ইউনুস সরকারের প্রাথমিক চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজনে বিরোধিতাকারীদের প্রতিরোধের বিষয়টি আসছে। জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কি কি শর্তে ডিপি ওয়ার্ল্ড ইজারা পাচ্ছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা দেওয়ার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লাভ – ক্ষতি কি তা প্রকাশ্যে না এনে ইজারা দেওয়ার প্রস্তুতি শেষ করে ফেলা বড় ধরণের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি। বর্তমানে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণ করছে রেড সি গেটওয়ে। কন্টেইনার প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে মাত্র ১৮ ডলার আর রেড সি গেটওয়ে পাচ্ছে ৭০-৮০ ডলার। বাংলাদেশের বন্দর সহ কোন প্রথিস্তানি দুর্নীতি মুক্ত নয়। বর্তমানে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল থেকে কন্টেইনার প্রতি ৪৭ ডলার আয় করছে। নিউমুরিং সবচেয়ে লাভজনক। দেশীয় অর্থে নির্মিত লাভজনক কন্টেইনার টার্মিনাল যেখানে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা আছে। সেই বন্দর কেন বিদেশী কোম্পানির কাছে দেওয়া হবে এর যোক্তিকতা ও অর্থনৈতিক বিষয়য়াদি সামনে নিয়ে আসার অপারগতা বিতর্ক ও বিরোধিতার সৃষ্ট করেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ডেনমার্কের শিপিং প্রতিষ্ঠান এপিএম মুলার ও রেড সৌদি সি গেটওয়ে কাজ করছে। ডেনমার্কের শিপিং প্রতিষ্ঠান এপিএম মুলার নিজ অর্থায়নে লালদিয়ায় চরে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করেছে।
ইজারা এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এখনো ‘গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট’ (জিটুজি) ভিত্তিতে প্রস্তাব বিবেচনার পর্যায়ে থাকলেও ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তারা টার্মিনালের ভেতরে ঢুকে কার্যত পর্যবেক্ষণ ও ‘প্রাথমিক দখলদারি’র আচরণ শুরু করেছেন। ডিপি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন আফ্রিকা, আরব আমিরাত, নেদারল্যান্ডস, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ফিনল্যান্ড ও ভারতের নাগরিক। ডিপি ওয়ার্ল্ডের৩৪ জনের মধ্যে ২১ জন ভারতীয় বংশোভূত। এর ফলে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা এবং চাকরি হারানোর আতঙ্ক।
বন্দর ইজারা দেওয়ার বিরুদ্ধে ইউনুস সরকার হুমকি দিয়েছে , প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বন্দর ইজরা দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রধানতঃ ছোট – ছোট বামপন্থী গ্রূপ প্রচার চালাচ্ছে। এই দল গুলোর সাংগঠনিক অবস্থান দুর্বল। বামপন্থীদের প্রায় সকলেই বিভিন্ন মাত্রায় জুলাই আন্দোলনে যুক্ত ছিল। হাসিনা পতনের আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে সংশয় ছিল এই দল গুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে। বিভিন্ন ভাবে বামপন্থীরা ইউনুস সরকারের নীতির কাছাকাছি আছে। প্রান্তিক বামদের প্রান্তিক অংশ বদরুদ্দীন উমর, টিপু বিশ্বাসরা অতি ইউনুস ঘেঁষা কথাবর্তা বলে আসছেন।
ইউনূসের শাসনের শুরু থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বামপন্থিরা হামলার ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। ঢাকায় সিপিবি অফিস দখলের চেস্টা হয়েছে। বামপন্থীরা হামলার নিশানার শিকার শুরু থেকেই। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের আস্ফোলন ” মুজিববাদী বামদের ক্ষমা নেই ” হচ্ছে বাপমন্থিদের আক্রমণের প্রাথমিক প্রস্তুতি – ঘোষণা। বামপন্থিরা ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে বন্দর – করিডোরের বিরোধিতায় নেমেছে। বন্দর ইজারাদানের বিরোধিতাকারীদের প্রতিরোধের ইউনূসের আহবান রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও ইউনুস অনুগত মব সৃষ্টির নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
তথ্য সূত্র:
১. ডিপি ওয়ার্ল্ডের ২১ ভারতীয় কর্মকর্তা ঢুকলেন বন্দরে, চট্টগ্রামে উত্তেজনা। ০২ জুন ২০২৫। আজকের পত্রিকা।