১
যুদ্ধ ও বিপ্লব ব্যাক্তি এবং সংগঠনের জন্য একটি মৌলিক পরীক্ষা। ইসরায়েল বর্তমানে ইরানের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালাচ্ছে, সেটিও এক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই সংঘাত মূলত মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র আঁকার লড়াই। ইরান- ইসরাইল সংঘাত কোন ধর্মীয় সংঘাত নয়। মধ্যপ্রাচ্যে অন্য মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে ইসরাইলের কোন সংঘাত নেই। জর্ডান – সিরিয়া -ইরাকের ভূমি ব্যবহার করেই ইসরাইলি আক্রমণ হচ্ছে। সৌদি আরবের প্রতক্ষ্য সহযোগিতা রয়েছে ইসরাইল-আমেরিকার যুদ্ধ যাত্রায়। তুরস্ক -মিশর -কাতার সহ এই অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্র গুলি আমেরিকার যুদ্ধ নীতির সহযোগি। এই রাষ্ট্র গুলি কখনো নিজ দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে ‘ যুদ্ধ বন্ধ ‘ ‘ শান্তি ‘ ‘ কূটনৈতিক সমাধানের লোক দেখানো আওয়াজ তুলে আসছে।
যদি ইসরায়েল এই যুদ্ধে বিজয়ী হয় এবং ইরানকে পরাজিত করে, তবে তা শুধু মোল্লাতান্ত্রিক শাসনের জন্য নয়, ইরানি জনগণ, ফিলিস্তিনি এবং গোটা অঞ্চলের সমস্ত নিপীড়িত জনগণের জন্যই একটি ভয়াবহ ধাক্কা হবে। এতে উপনিবেশবাদী ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য আরও দৃঢ় হবে। আর যদি ইরান এই আগ্রাসন প্রতিহত করতে সক্ষম হয়, তাহলে তা ইসরায়েলের জন্য একটি ভয়ঙ্কর ধাক্কা হবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে দেশটির অভ্যন্তরে একটি বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করবে। ইহুদিবাদি রাষ্ট্রের দুর্বলতা ফিলিস্তিনি, সিরীয়, লেবাননী এবং ইয়েমেনি জনগণের মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করবে। একই সাথে এটি এই অঞ্চলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্বও দুর্বল করবে।
২
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ কোন ধর্ম যুদ্ধ নয়। যদিও উভয় দেশের শাসক গোষ্ঠী ধর্মের রাজনৈতিক ব্যাবহারে কৌশলী সিদ্ধহস্ত। ইরান সরাসরি ইসলামী আইনের শাসন। ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে “ইহুদি ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র” । ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ উপাদানের মধ্যে একটি জটিল সম্পর্ক । ইসরাইল সরাসরি ধর্মতন্ত্র নয়, তবে ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে ইহুদিত্বের গভীর সংযোগ রয়েছে। ইসরাইল রাষ্ট্রের আইন ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ইহুদি পরিচয়কে প্রতিফলিত করে। একই সময়ে, ইসরায়েল সকল নাগরিকের জন্য—ধর্ম নির্বিশেষে—ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমতার নিশ্চয়তা দেয়। তবে সরকারের কার্যক্রম ও রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রভাব থাকার কারণে, ইসরায়েল প্রচলিত অর্থে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয় । ইসরাইলের পার্লামেন্টে সার্বজনীন ভোট নির্বাচিত মুসলিম সংসদ সদস্য রয়েছে। ইসরাইল সেনাবাহিনীতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ চাকুরীরত।
ইরানের শাসনব্যবস্থা প্রতিক্রিয়াশীল । একটি পুঁজিবাদী ধর্মীয় একনায়কতন্ত্র। দেশটির শ্রমিক, নারী এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের দমনে নির্মম ইরানি মোল্লাতন্ত্র । সিরিয়ার আসাদের স্বৈরশাসনকে সমর্থন দিয়ে সিরীয় জনগণের গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে ইরানি মোল্লাতন্ত্র। ইসরায়েল ও আমেরিকার সঙ্গে ইরানের এই সংঘাত কখনোই মোল্লা শাসনের অগণতান্ত্রিক চরিত্র নিয়ে নয়। শাহ রেজা পাহলভীর একনায়কতন্ত্র, যিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে দেশ শাসন করেছিলেন, এবং যিনি ছিলেন ওয়াশিংটন ও ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এই সংঘাতের মূল বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য। এই আধিপত্য বর্তমানে চরম সংকটে রয়েছে কারণ ইসরায়েল ছয় মাসের গণহত্যামূলক যুদ্ধের পরও হামাসকে নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে, হুথিরা লোহিত সাগরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে, এবং একাধিক আরব রাষ্ট্রে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধূমায়িত অসন্তোষ রয়েছে। যদি ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে ইরানকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এটি তাদের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে দুর্বল করে দেবে এবং ফিলিস্তিনসহ অন্যান্য নিপীড়িত জাতিগুলোর মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেবে। কিন্তু যদি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে পরাজিত করে, তাহলে তাদের এই দমনমূলক আধিপত্য আরও সুসংহত হবে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ মধ্যপ্রাচ্যে স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পক্ষে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সকল স্বৈরশাসকদের মদতদাতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। দুনিয়া ব্যাপি জনগণের মুক্তিকামী শক্তির বিরুদ্ধে আমেরিকা ভূমিকা রেখে চলছে । সবকিছুর পেছেন পুঁজিবাদী মুনাফা ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভূত্বের আকাঙ্ক্ষা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্ণবাদী-গণহত্যাকারী ইজরায়েল মরিয়া হয়ে উঠেছে ইরানকে ধ্বংস করতে। ইসরালী যুদ্ধ যাত্রার বিরোধিতা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ও সন্ত্রাসী শক্তির বিরুদ্ধ প্রতিরোধ। কোন বিরোধিতাই বিমূর্ত হতে পারে না। স্পষ্ট বিরোধিতার জন্য প্রয়োজন সুনিদৃস্ট বক্তব্য। সামনে আনতে হবে গাজার গণহত্যার ও হত্যাকারী ইসরালি এবং মদতদাতা আমেরিকার বিরুদ্ধে। মার্কিন-ইজরায়েলী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান কোন ভাবেই ইরানের মোল্লাতন্ত্রের প্রতি সমর্থন নয়। ইসরাইল- ইরান যুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে বামপন্থী আন্দোলনে নানা মত রয়েছে। বামপন্থীদের কোন কোন অংশ ‘নিরপেক্ষ ‘ ও বিমূর্ত অবস্থান নজর কাড়ে।
৩
১৯৮০ দশকের শুরু থেকে ইরানে কোন বিরোধী রাজনৈতিক দলকে টিকতে দেয়নি মোল্লাতন্ত্র। ১৯৭৯ সালের শাহ পতনের আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি তুদে পার্টির বড় ভূমিকা ছিল। সময়ের ব্যাবধানে তুদে পার্টি , ফেদাইন সহ বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের খুন করেছে মোল্লাতন্ত্র। যে কোন মুসলিম প্রধান দেশে বামপন্থীদের নিপীড়ণের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে নাস্তিক আখ্যা দেওয়া , কোরান – হাদিসের শত্রু ইত্যাদি। ইরানে বামপন্থী নিধনে একই প্রোপাগান্ডা ব্যাবহৃত হয়েছে। অতি অল্প সংখ্যক ইরানি বামপন্থী দেশ ছেড়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিদেশ থেকে ইরানি বামপন্থি দল গুলো সক্রিয়। ইরানের ভিতরে বামপন্থীদের কোন তৎপরতার সুযোগ নেই।
তুদে পার্টির বক্তব্য, ইজরায়েলের মতো একটি বিদেশি শক্তির আগ্রাসন ইরানের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের চরম বিরোধী। গোটা বিশ্বের প্রগতিশীল বামপন্থী জনতার কাছে ইজরায়েলের ঘৃণ্য আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে সোচ্চার আহবান জানিয়েছে তুদে পার্টি।এই বিবৃতিতে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রায় কোনও আক্রমণ নেই ৷ অপর দিকে যুদ্ধে ইসরাইল ও আমেরিকার পরাজয় বা ধ্বংসের স্লোগানকে প্রাধান্যে নিয়ে আসা হয়নি।
কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরান আরেকটি বামপন্থী দল। এই দলটি মূলতঃ ইরানি কুর্দিস্তানে সক্রিয়। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরান চলমান যুদ্ধকে
‘দুই কুকুরের লড়াই’ বলছে। “ইসরায়েলের ইরানে হামলার মাধ্যমে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তা ইরান ও ইসরায়েল নামক দুটি ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের মধ্যকার একটি সামরিক সংঘাত। এই সংঘাত উভয় দিক থেকেই জনবিরোধী।” সেই অনুযায়ী, দলটির মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো তেহরানের শাসন ব্যবস্থাকে উৎখাত করা। “বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি শাসন দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আরও ধ্বংসের জন্য যুদ্ধযন্ত্র প্রস্তুত করছে—এমন পরিস্থিতিতে এই প্রতিক্রিয়াশীল ও জনবিরোধী শাসনের পতন ঘটাতে পারলেই ইসরায়েল ও ইসলামি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে চলমান প্রতিক্রিয়াশীল যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি ঠেকানো যাবে।”
এই দল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অবস্থানকেও প্রত্যাখ্যান করছে। পরিবর্তে ইসরাইল – আমেরিকার ‘ রেজিম চেঞ্জ ‘ নীতির পরিপূরক আওয়াজ তুলেছে। নিঃসন্দেহে ইরানি সরকারক প্রধান শত্রু। সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণকে মোকাবেলা যুদ্ধ কালীন সময়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধকে প্রাধান্য দেওয়া এবং প্রতিরোধ যুদ্ধের মধ্যেও স্বাতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থান টিকিয়ে রাখা নীতি থেকে দূরে সরে গেছে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরান । এই দল চার দশকেরও বেশি সময় রাজনীতিতে সক্রিয়। এই সময় কালে বিভিন্ন পর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানি রাজতন্ত্রবাদীদের সঙ্গেও সহযোগিতা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইরান ।
কমিউনিস্ট-ওয়ার্কাস পার্টি প্রধানতঃ কুর্দিস্থান কেন্দ্রিক দল। এই দলের অবস্থান তুদে পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ে পৃথক। তাঁদের বক্তব্য, ইরানের ইসলামি শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের যে সংগ্রাম চলমান, এই যুদ্ধ তার উপর বিরাট আঘাত ৷ এই দল মনে করছে, এই যুদ্ধ আদতে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর হাতই শক্ত করবে ৷ কমিউনিস্ট-ওয়ার্কাস পার্টির বক্তব্য, ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে ইরানি জনতার মুক্তির জন্য ‘গাজার গণহত্যাকারী’ ইজরায়েলের কোনও প্রয়োজন নেই।
ইসরাইল- আমেরিকার আক্রমনের সময়ে ইরানের নির্বাসিত বামপন্থীদের সম্মিলিত কোন উদ্যোগে বা নূন্যতম যৌথ বিবৃতি দেওয়ার ব্যার্থতা হতাশা ব্যাঞ্জক। যে ৩/৪টি গ্রুপ বিবৃতি দিয়েছে। সব গুলো বিবৃতির রাজনৈতিক অবসান অস্পষ্ট। আমেরিকায় ইসরাইলের বিরোধিতাকে নমনীয় করে রাখা হয়েছে।
৪
ইসরাইল-ইরান যুদ্ধে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী না হওয়ার যুক্তি হিসাবে অনেকে দাবি করে থাকে ইরান নিজেই একটি সাম্রাজ্যবাদী বা উপ-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। ইরান মূলত একটি নির্ভরশীল দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের উপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইরানের কোনো আধিপত্য নেই। ইরানের শাসকগোষ্ঠী একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে কাজ করতে চায়, এবং তাদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী ইরাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ (যদিও নিয়ন্ত্রণমূলক নয়) প্রভাব, এবং সেইসঙ্গে সিরিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসক আসাদকে সামরিকভাবে সমর্থন দেওয়া। তবে সেই শাসনব্যবস্থা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার বিপ্লবের মাধ্যমে ভেঙে পড়ে এবং ইরান তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ইরানের চেষ্টা সীমিত সাফল্যই অর্জন করেছে।
সবশেষে, যদি আমরা ইরানের অর্থনীতির দিকে তাকাই, তাহলে স্পষ্ট বোঝা যায় এটি একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র নয়। একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি শক্তিশালী অর্থনীতি। যা অন্য দেশগুলোর ওপর আধিপত্য ও শোষণ চালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইরানের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই প্রযোজ্য নয়। ইরানের অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতার প্রতিফলন ঘটেছে এর মাথাপিছু জিডিপির অবস্থানে—২০২৪ সালে নামমাত্র (nominal) হিসাবে ইরান বিশ্বের মধ্যে ১১৭তম এবং ২০২৫ সালে ক্রয়ক্ষমতা সমতা (PPP) অনুসারে ৯৩তম স্থানে রয়েছে। এই অবস্থান ইরানকে ইরাক, সামোয়া, কেপ ভার্দে ও মাইক্রোনেশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড় করায়। অন্যদিকে, ইসরায়েল মাথাপিছু জিডিপি (nominal) অনুযায়ী ১৬তম স্থানে রয়েছে। তাই ইরান সাম্রাজ্যবাদী দেশ এই অজুহাতে ইসরাইলি আগ্রাসনে ইরানকে সমর্থন না করা বা নিরব থাকা রাজনৈতিক আত্মহত্যা।
৫
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে কোন দেশের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে সমর্থনের বিষয়ের নানান প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্ব শুধু “প্রগতিশীল” আর “প্রতিক্রিয়াশীল”—এই দুইটি রঙে বিভক্ত নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দুনিয়া শ্রেণিভিত্তিক এবং রাষ্ট্রভিত্তিক বিভাজনে গঠিত। প্রতিটি দেশের ভেতরে সমাজ বিভক্ত হয়েছে দুই মূল শ্রেণিতে—পুঁজিপতি শ্রেণি (বুর্জোয়া) ও শ্রমিক শ্রেণি (প্রলেতারিয়েত)। এছাড়াও রয়েছে অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণি ও স্তর, যেমন কৃষক, শহুরে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ইত্যাদি। বিশ্ব ব্যবস্থায় আধিপত্য করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ, যেখানে বড় শক্তি ও কর্পোরেট একচেটিয়া পুঁজিগুলো গোটা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং বাকি পৃথিবীকে শোষণ করে। মার্ক্সবাদীরা এসব নির্যাতিত দেশকে বলে “পুঁজিবাদী আধা-উপনিবেশ”—যেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হলেও প্রকৃতপক্ষে বড় শক্তি ও একচেটিয়া পুঁজির আধিপত্যে বন্দি।
একটি রাজনৈতিক শাসনের চরিত্র—তা কতটা গণতান্ত্রিক বা কতটা স্বৈরতান্ত্রিক—সেই দেশের জনগণের মুক্তিসংগ্রামের জন্য অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অন্য রাষ্ট্রের সাথে সংঘাত দেখা দিলে সেখানে মুখ্য হয়ে উঠে দুই পক্ষের শ্রেণিচরিত্র ও তাদের যুদ্ধের প্রকৃত লক্ষ্য। বর্তমান সংঘাতে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট। ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই বহু যুদ্ধ চালিয়ে নানা দেশ দখল করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব আরও বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর বিপরীতে, ইরানি শাসনব্যবস্থা তাদের জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায় (যার মধ্যে পরমাণু প্রযুক্তির অধিকারও অন্তর্ভুক্ত) এবং দীর্ঘমেয়াদে তারা নিজেদের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য রাখছে। এমন সংঘাতে, যেখানে একপক্ষ আধা-উপনিবেশ দেশ, যদিও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে পরিচালিত, আর অন্যপক্ষ একটি “গণতান্ত্রিক” সাম্রাজ্যবাদী শক্তি—সেখানে সমাজতান্ত্রিকরা সবসময় প্রথম পক্ষটির পক্ষেই অবস্থান নেবে এবং দ্বিতীয় পক্ষের পরাজয় কামনা করবে।
এ কারণেই মার্ক্সবাদীরা চীনকে সমর্থন করেছিল ১৯৩৭–৪৫ সালে জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। যদিও এই লড়াইয়ের নেতৃত্বে ছিলেন চিয়াং কাই-শেক, একজন প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরশাসক। যিনি হাজার হাজার কমিউনিস্টকে হত্যা করেছিলেন। আরেকটি উদাহরণ হলো—১৯৩৫–৩৭ সালে ইতালির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইথিওপিয়ার প্রতিরোধ—যার নেতৃত্বে ছিলেন সম্রাট হেইলে সেলাসি, যিনি ছিলেন একজন একনায়ক শাসক। তবুও, সমাজতান্ত্রিকরা এসব প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বাধীন দেশকেই সমর্থন জানিয়েছিল, কারণ তারা ছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার।