বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ন

নিউইয়র্কের মামদানি-ঝড়: আমেরিকার তীরে কি বামপন্থার ঢেউ লাগবে ? – সুমিত রায়

সুমিত রায়
সোমবার, ৩০ জুন, ২০২৫

রাজনীতি বড়ই অদ্ভুত জিনিস। কখন কী হয়, বলা মুশকিল। মানুষের মন বোঝা তার চেয়েও কঠিন। এই যেমন ধরুন, গত বছরের নির্বাচনের পর আমেরিকার রাজনীতিতে একটা ধারণা বেশ পোক্ত হয়েছিল। সবাই বলাবলি করছিল, ডেমোক্রেটিক পার্টি বড্ড বেশি বাম দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তাদের এখন মাঝপথে ফিরে আসা উচিত। কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। পরিসংখ্যানও খানিকটা সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। যারা নিজেদের ‘মধ্যপন্থী’ বলে পরিচয় দেয়, তাদের একটা বড় অংশ ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছিল। ডেমোক্রেটিক পার্টির বড় বড় নেতারাও চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারা কর্মীদের বোঝাতে শুরু করলেন, “পরিচয়ের রাজনীতি” (identity politics) নিয়ে বেশি লাফালাফি না করে বরং খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা ভাবা দরকার। তাদের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলা উচিত।
কিন্তু রাজনীতি তো আর সরল অংক নয় যে দুইয়ে দুইয়ে চার হবে। এই মধ্যপথে ফেরার চেষ্টা করতে গিয়ে ডেমোক্র্যাটরা পড়ল মহা বিপদে। শুল্কের মতো সাধারণ বিষয়েই তারা একমত হতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, পার্টিটা পথ হারিয়ে ফেলেছে।
ঠিক এমনই এক সময়ে কিছু ঘটনা ঘটতে শুরু করল, যা পুরনো ধারণাগুলোকে নাড়িয়ে দিল। তথ্য-উপাত্ত দেখাতে শুরু করল যে বামপন্থী প্রার্থীরাও নির্বাচনে জিততে পারেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে এলেন এক তরুণ, জোরান মামদানি। নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের প্রাইমারিতে তার বিজয় অনেককেই নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। তাহলে কি ডেমোক্র্যাটদের বাম দিকেই থাকা উচিত? নাকি আমেরিকার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা তাদের জন্য আরেকটি ভুল হবে? চলুন, ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
ছোট্ট এক শহরে বড় এক ঝড়
যেকোনো বড় পরিবর্তনের শুরুটা হয় খুব ছোট পরিসরে। নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচন ছিল তেমনই এক ছোট পরিসর, যেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভেতরের লড়াইটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একদিকে ছিলেন অ্যান্ড্রু কুওমো। রাজ্যের সাবেক গভর্নর, নামডাকওয়ালা রাজনীতিবিদ। টাকা, ক্ষমতা, পরিচিতি—কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তার। অন্যদিকে, ৩৩ বছর বয়সী এক তরুণ, জোরান মামদানি। নিজেকে ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে তার পক্ষে জনমত ছিল মাত্র ১ শতাংশ। সেখান থেকে তিনি পুরো খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।
মামদানির লড়াইটা ছিল অনেকটা ডেভিড আর গোলিয়াথের মতো। একদিকে দলের পুরনো, প্রভাবশালী নেতারা, অন্যদিকে এক নতুন মুখের তরুণ। মামদানি নিউইয়র্কের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেছিলেন। তার প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল খুব সাধারণ কিন্তু আকর্ষণীয়—বাস ভাড়া মওকুফ, নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ করা, সব শিশুর জন্য চাইল্ড কেয়ারের ব্যবস্থা এবং ধনীদের ওপর করের বোঝা বাড়ানো। একই সাথে, সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোতেও তিনি তার প্রগতিশীল অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।
তার প্রচারণার কৌশল ছিল চমৎকার। তিনি অ্যান্ড্রু কুওমোর দুর্বল জায়গাগুলোতে সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন। কুওমো যৌন হয়রানির অভিযোগে গভর্নর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং এই নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে ফিরতে চাইছিলেন। মামদানি সেই পুরনো ক্ষতকে বারবার সামনে এনেছেন। কিন্তু তার প্রচারণায় শুধু আক্রমণই ছিল না, ছিল এক ধরণের আশাবাদ। তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, যা তাদের মধ্যে সত্যিকারের এক উৎসাহ তৈরি করেছিল। তার সমর্থনের ভিত্তি ছিল বিভিন্ন জাতি, ধর্ম আর অর্থনৈতিক শ্রেণির মানুষের এক স্বতঃস্ফূর্ত জোট, যা কুওমোর রাজনৈতিক মেশিনকে পরাজিত করে (The New York Times, 2025)। ওবামা প্রশাসনের এক সাবেক কর্মকর্তা যেমনটা বলেছেন, “নিউইয়র্কে যা ঘটল, তা ডেমোক্রেটিক পার্টির সেইসব নেতাদের জন্য একটি সশব্দ সতর্কবার্তা, যারা এখনো পুরনো রাজনীতি আঁকড়ে ধরে আছেন এবং ভয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারেন না।” এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ডেমোক্রেটিক পার্টি কি বদলাবে, নাকি পুরনো পথেই হাঁটবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আগামী নির্বাচনগুলোতে মামদানির মতো আরও অনেক নতুন মুখ যে বড় বড় নামকে চ্যালেঞ্জ জানাবে, তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বার্নি স্যান্ডার্স এবং জনপ্রিয়তার রহস্য
শুধু নিউইয়র্কেই নয়, আমেরিকায় জাতীয় পর্যায়েও বামপন্থী নেতারা বেশ ভালো অবস্থানে আছেন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত সেনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং প্রতিনিধি আলেক্সান্ড্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ (সাধারণ্যে যারা ‘এওসি’ নামে পরিচিত)।
বার্নি স্যান্ডার্স স্বতন্ত্র রাজনীতিবিদ হলেও ডেমোক্র্যাটদের সাথেই কাজ করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্যান্ডার্স এবং এওসি সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের ‘ফাইটিং অলিগার্কি’ বা ‘ধনিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই’ নামের সফরগুলোতে হাজার হাজার মানুষের ভিড় হচ্ছে। এই সফরগুলোর মাধ্যমে তারা তাদের প্রগতিশীল বার্তা, বিশেষ করে বিলিয়নিয়ার এবং কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ডেমোক্রেটিক পার্টির একেবারে বাম প্রান্তে অবস্থান করেও তারা দুজনই প্রচণ্ড জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বার্নি স্যান্ডার্স এই মুহূর্তে আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (Morris, 2025)। অন্যদিকে, সেনেটের সংখ্যালঘু নেতা চাক শুমার বা ডেমোক্রেটিক পার্টির সার্বিক জনপ্রিয়তা অনেকটাই নিচের দিকে।
কিছু ডেমোক্রেটিক কৌশলবিদ মনে করেন, পার্টির উচিত চুপচাপ বসে থাকা এবং ট্রাম্পকে তার নিজের জালে নিজেকেই ফাঁসাতে দেওয়া (The New Yorker, 2025)। কিন্তু অন্যরা বলছেন, জনগণের আস্থা ফিরে পেতে হলে বার্নি স্যান্ডার্সের কাছ থেকে শিখতে হবে—গ্রহণ করতে হবে অর্থনৈতিক পপুলিজম বা জনতোষণবাদ (Politico, 2025; The Hill, 2025)। কথাটা বেশ যৌক্তিক মনে হয়, কারণ বিভিন্ন জরিপ বলছে, বড় কর্পোরেশন এবং ধনী পরিবারগুলোর ওপর কর বাড়ানোর নীতিটি বেশ জনপ্রিয় (Pew Research Center, 2025)।
কিন্তু… ব্যাপারটা কি এতই সোজা?
এখানেই গল্পের পরবর্তী মোড়। জাতীয় রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটদের জন্য বাম দিকে ঝোঁকা নিয়ে কিছু বিপদও আছে।
প্রথমত, জোরান মামদানির সাফল্য দেখে জাতীয় পর্যায়ের জন্য কোনো সিদ্ধান্তে আসাটা ঠিক হবে না। নিউইয়র্ক আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি বামঘেঁষা। আর মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ড্রু কুওমো ছিলেন কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত এক দুর্বল প্রার্থী। এটাও মনে রাখা দরকার, নিউইয়র্কের ওই প্রাইমারি নির্বাচনে মাত্র ১০ লক্ষ মানুষ ভোট দিয়েছিল। আর এই বছর ৪ নভেম্বরের চূড়ান্ত নির্বাচনেও জিততে মামদানির খুব বেশি ভোটের প্রয়োজন হবে না, কারণ নিউইয়র্কের স্থানীয় নির্বাচনগুলো হয় অদ্ভুত সময়ে—মধ্যবর্তী এবং সাধারণ নির্বাচনের মাঝামাঝি বছরে। ফলে ভোটার উপস্থিতিও থাকে খুব কম। যেমন, ২০২১ সালে ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ (NYC EDC)।
দ্বিতীয়ত, বার্নি স্যান্ডার্স এবং এওসি জনপ্রিয়, এটা সত্যি। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তার কারণ কি তাদের বামপন্থী নীতি? জরিপের গভীরে গেলে উত্তরটা একটু অন্যরকম মনে হয়। ‘ডেটা ফর প্রগ্রেস’ নামের একটি সংস্থার জরিপে অংশগ্রহণকারীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তারা কেন স্যান্ডার্সকে পছন্দ বা অপছন্দ করেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা স্যান্ডার্সকে পছন্দ করেন, তাদের খুব কম সংখ্যকই তার বামপন্থী নীতির কথা বলেছেন। বরং, পছন্দের তিনটি প্রধান কারণ ছিল: ১) তাকে অনেক বেশি অকপট বা খাঁটি মনে হয়, ২) তিনি রাজনৈতিক এস্ট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান না, এবং ৩) তিনি তার বক্তব্যে সব সময় অটল থাকেন।
অন্যদিকে, যারা স্যান্ডার্সকে অপছন্দ করেন, তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের প্রধান কারণ ছিল তার বামপন্থী নীতি (Ettingermentum.news, 2025)।
এর থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায়, স্যান্ডার্সের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হয়তো তার নীতি নয়, বরং তার সততা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী ভাবমূর্তি। এই একই কথা হয়তো জোরান মামদানির ক্ষেত্রেও সত্যি। তিনি বামপন্থী ঠিকই, কিন্তু তার আসল আকর্ষণ ছিল এই যে, তিনি নিজেকে রাজনৈতিক এস্ট্যাবলিশমেন্টের বাইরের একজন হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, যিনি অ্যান্ড্রু কুওমোর মতো এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তৃতীয়ত, অন্যান্য জরিপ বলছে যে বামপন্থী নীতি, বিশেষ করে সাংস্কৃতিক এবং অভিবাসন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে, আমেরিকায় খুব একটা জনপ্রিয় নয়। যেমন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে অভিবাসন এবং ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’ (Affirmative Action) নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের অবস্থান মধ্যপন্থী ভোটারদের থেকে অনেক দূরে ছিল, যা তাদের ভোটের বাক্সে আঘাত হেনেছিল (Financial Times, 2025)। তবে এর একটি উল্টো পিঠও আছে। বামপন্থী সামাজিক নীতিগুলো হয়তো এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অজনপ্রিয়, কিন্তু ট্রাম্প যদি বাড়াবাড়ি করেন, তবে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। আর অর্থনৈতিক নীতিগুলোর ক্ষেত্রে চিত্রটা ভিন্ন।
বার্নি স্যান্ডার্সের মূল অর্থনৈতিক নীতিগুলো—যেমন ধনীদের ওপর উচ্চ কর, ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি, এবং মেডিকেয়ারের সম্প্রসারণ—বেশ জনপ্রিয়। ব্লুমবার্গের গত বছরের এক জরিপে দেখা গেছে, বছরে ৪ লক্ষ ডলারের বেশি আয় করা ব্যক্তিদের ওপর কর বাড়াতে চান ৬৯% আমেরিকান, আর কর্পোরেশন কর বাড়াতে চান ৫১% (Bloomberg, 2024)। ‘ডেটা ফর প্রগ্রেস’-এর জরিপ অনুযায়ী, ৬৪% মানুষ ন্যূনতম মজুরি ঘণ্টায় ৭.২৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৭ ডলার করার পক্ষে (Data for Progress, 2024)।
শেষ কথা
তাহলে এই দীর্ঘ আলোচনার সারমর্ম কী?
সম্ভবত মূল শিক্ষাটা বাম বা ডানদিকে ঝোঁকার মধ্যে নেই। স্যান্ডার্স এবং মামদানির সাফল্য থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষাটা পাওয়া যায়, তা হলো: ডেমোক্র্যাটদের উচিত নিজেদেরকে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ এবং ‘অকপট’ হিসেবে উপস্থাপন করা। এই কাজটি ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতে খুব সফলভাবে করেছেন। একজন রাজনীতিবিদ যখন জরিপের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন তার অবস্থান বদলান, তখন ভোটাররা সেটা ধরে ফেলে। তাদের কাছে এই পরিবর্তনকে কৃত্রিম এবং সুযোগসন্ধানী মনে হয়। ডেমোক্র্যাটরা যদি এখন তাড়াহুড়ো করে মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকতে যায়, এবং সেই ঝোঁকটা যদি ভোটারদের কাছে মেকি মনে হয়, তবে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ভোটাররা কি নীতির দিকে তাকাবে, নাকি একজন সৎ এবং অকপট চেহারার দিকে? রাজনীতির এই জটিল অংকের উত্তর হয়তো সময়ই বলে দেবে। তার আগ পর্যন্ত, ডেমোক্রেটিক পার্টিকে এই কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে ফিরতে হবে।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!