বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:৪০ অপরাহ্ন

করিয়া নয় ভাবিয়া ভাল ……

বুলবুল তালুকদার 
বুধবার, ২ জুলাই, ২০২৫

“খোলা জানালা”- স্পষ্ট একটি কথা বলি, আগামীতে যে দলই ক্ষমতায়ন হোক তারা কেউই অনমনীয় (inflexible) সরকার আর হবার সুযোগ পাবে না। যে কোন দল ক্ষমতায়ন হোক না কেন তাদেরকে নমনীয় (flexible) সরকারই হতে হবে। হ্যা শব্দটি আমি ফ্যাসিবাদী (Fascist) লিখতে পারতাম তবে ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞায়ন বা অর্থ আমরা ইতিমধ্যেই জগাখিচুড়ি করে ফেলেছি বলেই নমনীয়/ অনমনীয় শব্দ দুটো বেছে নিলাম।
ফ্যাসিবাদী সরকার মানেই গুম- খুন- রাহাজানি থাকবে তবে ফ্যাসিবাদী মানেই কিন্ত অর্থ লুটপাট থাকে তেমনটা মোটেও নয়। উদহারণস্বরুপ এই বিশ্বের বহু রাষ্ট্র পাবেন তাই উদহারণ লিখছি না। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকে যত সরকারই এসেছে সবাই কোন না কোনভাবে ফ্যাসিবাদের অংশ ছিল, এটা কঠিন সত্য তবে ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় একপ্রকার জগাখিচুড়ির ফ্যাসিবাদী ছিল বলেই প্রতিয়মান হয়। আমাদের সরকারগুলো আজ অবধি গুম- খুন- রাহাজানির সাথে অর্থ লুটপাটেও বেশ দক্ষ ছিল। অবশ্য ওটা দক্ষতা না বলে ভিন্ন শব্দে বলা যায় “বাজে সরকার” ছিল। বাজে শব্দটির ব্যবহারেই মূলত একটি সরকারের বহু চরিত্র প্রকাশ পায় এবং একটি সরকারকে বাজে বললেই বুঝার জন্য যথেষ্ট হয়। ছোট্ট শব্দ বাজে দ্বারাই সব বলা হয়ে যায় কিন্ত।
অর্থ লুটপাট করে না তবে কঠিন ফ্যাসিবাদী সরকার হয়ে উঠে এমন উদহারণ সবচাইতে বেশি ধর্মভিত্তিক সরকারগুলো। একটি রাষ্ট্র যখন ধর্মের ভিত্তিতে চলে, সেই সরকারগুলো সর্বদাই সর্বোচ্চ ফ্যাসিবাদের সরকার হয়ে উঠে কেননা সেই সব সরকারগুলো গণতন্ত্রের বিপরীতে এবং মানুষের জীবনের স্বাভাবিক স্বাধীনতার বিপরীতে ধর্মের অনুশাসনে জনমানুষদের জীবনকে বন্দি জীবনে বেঁধে ফেলে। এই যে মানুষের মানবিক ও সাধারণ জীবনকে ধর্মের দ্বারা বন্দি করা হয় বা বাধ্য করা হয়, সেটাই বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ ফ্যাসিবাদ। তাই বলাই বাহুল্য ফ্যাসিবাদের প্রকারভেদ আছে এবং সেই পার্থক্যটি আমরা প্রায়শই গুলিয়ে ফেলি।
একটি উদহারণ দেই। জানি না উদহারণটি কতটা গ্রহণযোগ্য হবে তবে ভাবনায় এলো বলেই লিখছি। এই যে গত আওয়ামী সরকারকে ফ্যাসিবাদী সরকার আমরা বলি এবং অবশ্যই আওয়ামীরা গত রেজিমে ফ্যাসিবাদী ছিল, বরাবরের মতন অন্যান্য সরকারগুলোর মতন (যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ফ্যাসিবাদী সরকার না লিখে এককভাবে উল্লেখ করে লিখি গুম- খুন- লুটরাজের সরকার), একবার ভাবুনতো, গত আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে যত গুম- খুনের অভিযোগ আছে এবং যত প্রমাণ আছে, তারপরেও যদি আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাটে না থেকে শতভাগ সৎ থাকতো, তাহলেও কি আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনমানুষের এতটা ক্ষোভ থাকতো? সেখানে আমার বেশ সন্দেহ জাগে (ব্যক্তিগত মত)। এই বিশ্বে গণতন্ত্রের নামে বাস্তবিক গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন, সর্বত্রই অনেক রক্ত জড়িয়ে আছে। নির্মম সত্য হলো বিনা রক্তপাতে বিশ্বের কোন দেশেই গণতন্ত্র আসেনি।
ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী সরকারের কথা লিখতে গিয়ে কেন আমি রক্তপাতের কথা লিখছি? কারণটি হলো, রক্তপাত বিশ্বের সর্বত্রই এবং সব দেশেই হয়েছে এবং হচ্ছে তবে সেই রক্তপাতকে ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে জনমানুষের কল্যাণে কাজে লাগিয়ে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর রাষ্ট্র রাখতেই বিশ্বের বহু রাষ্ট্র স্বার্থক হয়েছে এবং বাস্তবিক অর্থেই জনমানুষের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। এই যে আজকের দিনে ইউরোপের দেশগুলো এতটা গণতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, এর পিছনেও অন্তত পঞ্চাশ মিলিয়নের উপরে মানুষের রক্ত জড়িয়ে। ভাবা যায় ইতিহাস কতটা কঠিন? এত রক্তপাত অতঃপর গণতান্ত্রিক দেশ হতে পেরেছে একমাত্র রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারাই। স্মরণে রাখা ভাল যে, বিশ্ব চলে রাজনীতি দ্বারা। বিশ্বের যত কল্যাণ হয়েছে সবই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারাই ঘটেছে। তবে আরও লক্ষ্যণীয যে, সব কল্যাণ গণতান্ত্রিক রাজনীতির দ্বারাই ঘটেছে। কোন ধর্মের রাজনীতি বা ধর্মভিত্তিক অনুশাসন দ্বারা নয়।
লেখার শুরুতেই লিখেছি, আগামীর যে কোন সরকার অনমনীয় (inflexible) সরকার হয়ে উঠতে পারবে না। এমনকি সংসদে যদি ৩০০ আসনেও কোন দল জয়ী হয়, তারপরেও অনমনীয় হবার সম্ভাবনা থাকবে না কারণ আওয়ামীদের পতনের সাম্প্রতিক উদহারণটাই যথেষ্ট হবে। বেশ অবগত আছি যে, দেশের বিজ্ঞ ও জ্ঞানী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বেশ উচ্চারণ করছেন, বেশি আসনে জয়ী হয়ে আসলে আবার ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠবে নির্বাচিত সরকার। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকেও তেমনটাই বলা হচ্ছে, আগামীত যে কোন সরকারের ফ্যাসিবাদীতা রুখতে হলে, হ্যান- ত্যান- ইত্যাদির সমাধান করে যেতে হবে। যদিও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি কি করে যেতে পারবে? ওটা ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে এবং ভরসা করাটাই শতভাগ বোকামি বলেই মনে করি। আবার বহু বিজ্ঞজনদের ভাষায় দেখছি, ওগুলো সব বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অযাচিত বুলি মাত্র। সরকারের চিন্তাভাবনা একেবারেই ভিন্ন (আমি সেই চিন্তাভাবনার কথায় এই লেখায় যাচ্ছি না)।
সেই সব হ্যান- ত্যান- ইত্যাদির ভাবনা থেকেই সরকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েই হোক বা দেশের বহু রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভাবনা থেকেই হোক, দেশে বর্তমানে পিআর বা আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার (Proportional representation) একপ্রকার দাবী উঠেছে। না, আমার আজকের লেখা মূলত পিআর নিয়ে নয়। যৌক্তিক বা অযৌক্তিক দাবী কিনা? সেটা বহুকিছুর উপরেই নির্ভরশীল বটে
সামান্য একটু লিখছি, মূলত পিআর পদ্ধতি নিয়ে:
আনুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা হলো এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে ভোটারদের রায় প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির হার অনুযায়ী। সামান্য কিছু বেশি ভোট পেয়ে কোনো দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, আবার কাছাকাছি ভোট পেয়েও অন্য দল নামমাত্র আসন পায়, এটা সমস্যা এবং অবশ্যই সমস্যার বটে কেননা এভাবে ক্ষমতায়ন হয়ে দলগলো রুক্ষ হয়ে উঠে, অন্তত আমাদের মতন তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশেতো বটেই। এগুলো সবই বাস্তবিক সত্য। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই যে রুক্ষ হবার কথা আমরা বহুজনেই বলছি, ওটা রুখতে কি বর্তমানের বাস্তবায়নে, সত্যিই কি পিআর পদ্ধতিই একমাত্র সমাধান?
উত্তরটি সরাসরি হচ্ছে না। কেন না? ওটা লিখতে গেলে পিআর নিয়ে বিশদ আকারে লিখতে হবে। ওটা আজকের লেখার বিষয় নয়। তবে এতটুকু লিখছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে গেলে সব এলোমেলো হয়ে ডালে- চালে খিচুড়ি হয়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে। যে সর্বনাশ থেকে ফিরতেও পারবে না রাষ্ট্রটি। বহুজনের লেখায় দেখছি পিআর পদ্ধতি ওমুক দেশে আছে, এত এত দেশে আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের বিজ্ঞজনদের সেই সব লেখা দেখে সম্মানের সাথেই হাসতে হয় কেননা উনারা অর্ধেক বা বর্তমানটা লিখেন তবে ওমুক দেশ বা তমুক দেশ, কখন এবং কিভাবে পিআর পদ্ধতিতে প্রবেশ করলো এবং কেন? সেগুলো উল্লেখ না করে পথ প্রদর্শন করেন। যখন এমন পিচ্ছিল পথ প্রদর্শন বিজ্ঞজনদের থেকে দেখি, তখন ভাবি উদ্দেশ্য ও উপলক্ষ্যটা মূলত কী?
যাকগে সেই সব কথা। দেশের একটি বাস্তবিক উদহারণ দেই (জাতীয় পত্র পত্রিকায় এসেছিল), লোহার বদলে বাঁশ দিয়ে ঢালাই, সেই গড়া ভাঙ্গতে কয়দিন? লেখার শেষে, প্রাচীন ভারতের প্রখ্যাত পণ্ডিত, শিক্ষক, দার্শনিক, রাজউপদেষ্টা চাণক্যের বচন দিয়েই শেষ করছি, “করিয়া নয়/ ভাবিয়া করিও কাজ”।
বুলবুল তালুকদার
অষ্ট্রিয়া – লিঞ্জ
সমসমাজ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য
সমসমাজ.কম


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!