কুশল বরণ চক্রবর্তী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির সাক্ষাৎকারে আসা শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তীকে ঘিরে হট্টগোল, ‘মব’ সৃষ্টি করে হেনস্তা করা হয়েছে । শেখ হাসিনার পলায়নের পর সারা দেশে হিন্দু শিক্ষকদের উপর হামলা ও পদত্যাগে বাধ্য করা কাফেলায় আরেকটি নাম যুক্ত হলো। গণ মাধ্যম প্রত্যক্ষদর্শীদের উদৃতি করে লিখেছে , কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতির সাক্ষাৎকারের খবরে ছড়িয়ে যাবার পর প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নেন শাখা ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদেরনেতা-কর্মীরা। এ অবস্থান কর্মসূচিতে থেকেই বিকেল চারটার দিকে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া হয়। কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতি বোর্ড বাতিল করে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্তের দাবি করেন মব সৃষ্টিকারী ছাত্ররা । এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা হাবিবুল্লাহ খালেদ উচ্চ স্বরে কথা বলছেন। তাঁর সঙ্গে থাকা অন্যরা হইচই করছেন। তাঁদের সামনে শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্তী। উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহইয়া আখতার, সহ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে উপাচার্যকে নির্লিপ্তভাবে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেছে। ভিডিওতে তাদের কয়েকজনকে ওই শিক্ষকের সাথে তর্ক করতে এবং তাকে পদোন্নতি দেয়া যাবে না বলে চিৎকার করতে দেখা যায়। এই সময় উপাচার্যের উদ্দেশ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, ”আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি, আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেছেন , ” মব সৃষ্টি করে হেনস্তার অভিযোগ মিথ্যা। বরং কুশল বরণ চক্রবর্তী চেয়েছিলেন যে তিনি হেনস্তার শিকার হন। এ কারণেই শিক্ষার্থীরা যখন দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলতে গেছে, তখন তিনি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছেন। কুশল বরণের আজকের এ অবস্থার জন্য তাঁর অতীত কর্মকাণ্ড দায়ী।” ঘটনার সময় উপাচার্য সহ অন্য শিক্ষকদের নির্লিপ্ততা ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের বক্তব্য একই সূত্রে গাঁথা। বিশ্ববিদালয়ের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য হচ্ছে ভিক্টিম ব্লেইমিং। কোনো অপরাধ বা নিপীড়নমূলক ঘটনায় জন্য ক্ষতিগ্রস্ত তথা ভিক্টিমকেই দোষ ও দায় দেওয়াকে ভিক্টিম ব্লেইমিং বলে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কম-বেশি সবসময় ভিক্টিম ব্লেইমিং এর চর্চা করে আসছে। ভিক্টিম ব্লেইমিং এর প্রধান টার্গেট হচ্ছে নারী , ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু ও অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষ। শেখ হাসিনার পলায়নের পর ‘ মব ‘ সন্ত্রাস ও হিন্দু নির্যাতন মহামারী রূপ নিয়েছে। ইউনুস সরকারের আমলে রাষ্ট্র সরাসরি ‘মব জাস্টিস ‘কে পৃষ্টপোষকতা করছে। ইউনুস সরকারের প্রেস সচিব ‘মব’ সৃষ্টিকে প্রেশার গ্রুপ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। গত এক বছরে রাষ্ট্রীয় মদদে মব সৃষ্টি করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিমূল করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনার উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আক্রমণ গুলো হচ্ছে স্টেট স্পনসর্ড ভিক্টিম ব্লেইমিং’। এই আক্রমণ গুলো সুপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যার সাথে বিভিন্ন কর্পোরেট ও এনজিওভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম জড়িত থাকে। এই প্রক্রিয়ায় সরকারের সাথে সম্পর্কিত কিংবা এই চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত বুদ্ধিজীবী, এক্টিভিস্ট কিংবা অন্য পরিচয়ের মানুষও জড়িত থাকে।
বছর তিনেক আগে কুনাল চক্রবর্তী পদোন্নতির জন্য আবেদন করেছিলেন। নানান জটিলতার কারনে এই প্রক্রিয়া থমকে ছিল। এই থমকে থাকা দেশের একটি স্বাভাবিক চিত্র। হঠাৎ করে সপ্তাহ খানকে আগে পদোন্নতির জন্য পরীক্ষার এবং তারিখও নির্ধারন হয়। শুক্রবার , ৪ জুলাই পরীক্ষার দিন নির্ধারিত হয়েছিল । যে কোন পদোন্নতির পরীক্ষা নিতান্তই প্রশাসনিক বিষয়। একজন শিক্ষকের পদোন্নতির পরীক্ষা সর্বসাধারণের জানার বিষয় নয়। ১০/১৫ শিক্ষকতার পদন্নোতির মাপকাটি হওয়া উচিত সেই শিক্ষকের মৌলিক গবেষণা, প্রকাশনার বিষয়। কিন্তু এই ভূখণ্ডে এই বিষয়টি সব সময়ের জন্য উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষকের দক্ষতা নির্ধারণের জন্য যাঁরা দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন , তাঁদের মধ্যে কত জন এই ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন তা বিবেচ্য বিষয়। গত ৪ জন পরীক্ষক এরমধ্যে একজন নারী যিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী; বাকী তিনজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই পদোন্নতির পরীক্ষায় ঢুকে পড়ে মব – প্রেসার গ্রুপ। মব – প্রেসার গ্রুপের্ তান্ডব কুশলের পদোন্নতি বোর্ড প্রত্যাহার করব রচনা করে। কুশল চক্রবর্তীর জন্য অকুশল বয়ে আনে। কুশল বরণ চক্রবর্তী মব সন্ত্রাসের ইতিহাসের আরেক সংযোজন।
কুশল বরণ চক্রবর্তী দেশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে সরব ছিলেন। রাজনৈতিক ভাবে তিনি আওয়ামী ঘরনার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কুশল বরণ চক্রবর্তীকে ” ভারত” ” আরএসএস বিজেপি ” এজেন্ট বানিয়ে নানান কথা লেখা হচ্ছে। কুশল চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগী আদিত্যনাথের ছবি দেখিয়ে তার উপর মব হওয়ার সাফাই গাওয়া ও মবকে ন্যায্য করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সাল ভারতের যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বিজিপির নেতা। বিজিপির শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যা লঘু , নারী ও বামপন্থীদের উপর বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন চলে আসছে। বলেছেন ভারতে পড়াশোনা করার সময় একটা পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগি আদিত্যনাথের সঙ্গে ছবি তোলা কথা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন কুশল চক্রবর্তী ।
বিজেপি প্রতিক্রিয়াশীল দল। ভারতের ক্ষমতা ও রাজনীতিতে বিজেপিকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কাশ্মীরে বিজেপির সাথে সরকার গঠনের সংবাদ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। উত্তর প্রদেশ বা অন্য কোথায় যদি কোন মুসলিম বা দেওবন্দী কোন কারণে যোগী আদিত্যনাথ বা বড় কোন বিজেপি নেতার সাথে সাক্ষাতের ছবি প্রকাশ পায় তবে সেই মুসলিম বা দেওবন্দী বিজেপির বা আরএসএস এর এজেন্ট হয়ে যান না। কুশল চক্রবর্তীর এই জাতীয় ছবি দেখিয়ে মব তৈরির মওকা নেওয়া সম্ভব। তবে এই মওকার সাথে ন্যায্যতার কোন সম্পর্ক নেই। কুশল বরণ চক্রবর্তী বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের অন্যতম মুখপাত্র, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ এর সাথে যুক্ত। সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক একটি সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ছাত্র সংগঠন। এই সংগঠন গুলো দেশের আইন মেনেই সাংগঠনিক কাজ করে যাচ্ছে। হাসিনার পলায়নের পর ডঃ কুশল বরণ চক্রবর্তীর দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্টীর উপর নিপীড়ন, নির্যাতন,ধর্ষনের প্রতিবাদ আসছিলেন।
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করাই হচ্ছে দালাল হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হওয়া । দল মত নির্বিশেষে মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নকে ভারতের প্রোপাগান্ডা বলার প্রবণতা অতি শক্তিশালী। হাসিনার আমলে মুনতাসির মামুন জাতীয় বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বললে ‘ বিজিপির ‘ এজেন্ট হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে জনকণ্ঠ বা অন্য পত্রিকায় ‘ বিশ্লেষণী ‘ প্রতিবেদন লিখে ফেলতেন। ইউনূসের আমলে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। এখন মব ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়ার সংস্কিতি শুরু হয়েছে পাশাপাশি মবকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাবহারের করা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে ভারতের দালাল হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হয় । দল মত নির্বিশেষে মুসলিম সমাজে সাম্প্রদায়িক নিপীড়নকে ভারতের প্রোপাগান্ডা বলার প্রবণতা অতি শক্তিশালী। হাসিনার আমলে মুনতাসির মামুন জাতীয় বুদ্ধিজীবীরা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বললে ‘ বিজিপির ‘ এজেন্ট হিসাবে দাগিয়ে দিয়ে জনকণ্ঠ বা অন্য পত্রিকায় ‘ বিশ্লেষণী ‘ প্রতিবেদন লিখে ফেলতেন। ইউনূসের আমলে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। এখন মব ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়ার সংস্কিতি শুরু হয়েছে পাশাপাশি মবকে বৈধতা দেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাবহারের করা হচ্ছে।
সাম্প্রদায়িকতা রাজনৈতিক হাতিয়ার। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে প্রতিবাদের মানুষের সংখ্যা অতি নগন্য। বামপন্থিরা খুব বেশি সরব নয়। বদর উদ্দিন উমর প্রভাবিত অংশ সব কিছুকেই রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে দাগিয়ে দিতে অভ্যস্থ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে নিপীড়নকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে নিপীড়নকে মেনে নেয়। উমরতন্ত্রের বাইরের বামপন্থীরা দেশে সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি সম্পর্কে তেমন উচ্চ কণ্ঠ নয় তবে পৃথক ভাবে সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে সামনে নিয়ে আনতে দ্বিধান্বিত। যার কারণে লালমনিরহাটে নাপিত পিতা- পুত্রের উপর হামলা – গ্রেফতার বা মুক্তির ব্যাপারে কোন অবস্থান নেই। কুশল চক্রবর্তী বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষক। জুলাই আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সবচেয়ে পরিচিত মুখ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কয়েকজন শিক্ষক। কুশল চক্রবর্তীকে হেনস্তা করার পরেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নিরব। অবস্থা দৃষ্ঠে মনে হচ্ছে শিক্ষক নেটওয়ার্কের ধর্ম আছে।
সহায়ক তথ্য সূত্র :
১. ‘মব’ বলব না, এটা প্রেশার গ্রুপ: প্রেস সচিব। ২৬ জুন ২০২৫। যায় যায় দিন।
২. উপাচার্যকে শিক্ষার্থীরা বললেন, ‘আপনাকে আমরা বসিয়েছি, নিজের যোগ্যতায় আসেননি’ । ৫ জুলাই ২০২৫। প্রথম আলো।
৩. চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির সাক্ষাৎকারে আসা শিক্ষককে ঘিরে হট্টগোল, ‘মব’ সৃষ্টির অভিযোগ। ৫ জুলাই ২০২৫। প্রথম আলো।