পাঁচ আগস্ট নিয়ে ছোট্র করে, যাহা বলিব সত্য বলবি, সত্য বিনা মিথ্যা বলিব না” আদালতের কাঠগড়ার প্রতিজ্ঞায় স্রেফ আপন ভাবনা বলবো। গ্রহণ বা অগ্রহণ সবার নিজেস্ব বিচার। আগস্ট মাস। এই মাসটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের মাস- কলঙ্কের মাস এবং একটি অভ্যুত্থানের জয়ের মাস। কেন এভাবে লিখছি? কেননা এই আগস্ট মাসেই ১৫ আগস্ট এসেছিল, এই আগস্ট মাসেই ২১ আগস্ট এসেছিল অতঃপর এক বছর পূর্তি হলো এই আগস্ট মাসেই ৫ আগস্ট এসেছিল।
যে যেভাবেই লিখি আর যেভাবেই বলি বাস্তবতা হচ্ছে এক বছর পূর্বে আজকের এই পাঁচ আগস্টে বিগত ১৬ বছরের একটি কঠিন থেকেও কঠিনতম সরকারের পতন হয়েছিল সার্বজনীন জনমানুষের উপস্থিতী ও সরাসরি অংশগ্রহণে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, আমি ফ্যাসিস্ট সরকার লিখি না এবং বহু লেখায় ব্যাখ্যা দিয়েছি, কেন? আবার বলি ফ্যাসিস্ট সরকার মানে গুম- খুনের সরকার বলেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বুঝানো হয় তবে ফ্যাসিস্ট সরকার মানেই দূর্নীতির সরকার সব সময় হয় না। বহু উদাহরণ এশিয়া মহাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী আছে। থাক সেই আলোচনা। তবে আমি উল্লেখ করে করে প্রায়শই লিখি, গুমের সরকার, খুনের সরকার, দূর্নীতির সরকার, দখলদার সরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। যা হোক, বাস্তবিক অর্থেই জনমানুষের আকাঙ্খার একটি নিদর্শন নিশ্চিত ছিল পাঁচ আগস্টে আওয়ামী সরকারের পতন। সেটা আন্দোলনের সময় জনমানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত প্রমাণ করে।
পাঁচ আগস্ট সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা আছে। সরকারী ছুটি মানেই বিশেষ উপসর্গ থাকবে। প্রশ্ন হলো সেই বিশেষ উপসর্গের প্রত্যয়- প্রত্যাশা- প্রাপ্তি- অপ্রাপ্তি বাস্তবিক অর্থেই কতটুকু? এবং আরও আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করতেই হয়, কোন পথে বাংলাদেশ? জ্বি হা, কোন পথে বাংলাদেশ প্রশ্নটি অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও জড়িয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ করতেই হয়, কোন পথে বাংলাদেশ যাবে বা হবে, এই প্রত্যাশার আলোকেই মূলত পাঁচ আগস্ট ঘটেছে, যেখানে স্পষ্টতই সকলের ভাবনা ছিল, বাংলাদেশ সেই পথেই থাকবে, যে পথে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার স্বত্ব থেকে কখনোই পিছিয়ে আসবে না কেননা এই দেশটি যুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়েই জন্ম হয়েছে যে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পাঁচ আগস্ট পরবর্তীতে অনাকাঙ্খিত হলেও বাস্তবিক সত্য হলো সর্বপ্রথম স্বাধীনতার স্বত্ত্বায় আঘাত প্রাপ্ত হয়। স্বত্ত্বা শব্দের অর্থ বা মূল মর্মার্থ হলো “অধিকার” বা “মালিকানা”। এক বছর পূর্তিতে এসে আজকের এই দিনে দেশে সার্বভৌমত্ব নিয়ে যখন জনমানুষের মনে শঙ্কা দেখা দেয় এবং প্রশ্ন উঠে, তখন ভাবনা আসবেই কেন তাহলে পাঁচ আগস্ট ঘটলো?
পাঁচ আগস্টের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এগুলোতে শত- হাজার প্রশ্ন উঠবে এবং উঠাটাও স্বাভাবিক হবে কেননা গত ৫৪ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশ স্বাধীনতার লক্ষ্য- উদ্দেশ্য যখন পূরণ করেনি বা করতে পারেনি, তখন কিভাবে বা কত ভাবে, সেই ৫৪ বছরের আক্ষেপ পূরণে শত শত প্রশ্ন সামনে আসার কথা অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই সকল জনমানুষের চাওয়া- পাওয়া বা আকাঙ্খার সকল প্রশ্নকে ছাপিয়ে, দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠে তখন ভাবতেই হয়, কেন স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন? কেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন আজ নাকের ডগায় পাঁচ আগস্ট দাঁড় করিয়ে দিল?
ঠিক সেখানটায় ভাবনায় ঘোল লাগে এবং সন্দেহের জোগান হয় এবং সেই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন পথ খোলা রাখেনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার। সুতরাং প্রশ্ন যখন ভাবায় তখন পাঁচ আগস্টকে নানান বিচারে দেখা মোটেও অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই স্পষ্টতই মনে করি।
সেই ভাবনা থেকেই আজকে এক বছর পূর্তিতে পাঁচ আগস্ট সমন্ধে প্রথমেই স্পষ্ট করেই বলছি, পাঁচ আগস্টের সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান রাখি এবং সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুলিশ শহীদ সদস্যদের প্রতিও সমসম্মান রাখি এবং সকল হত্যার আইনি বিচারের প্রত্যাশা করি। রাষ্ট্র দ্বারা হত্যা এবং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, কোন হত্যাকাণ্ডকেই নিচু করে দেখার সুযোগ রাষ্ট্রের থাকতে পারে না এবং এমনটা না ঘটুক।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আলাদা করেই বলতে হয়। কেন সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন দেখা দিল? যেখানে পূর্বের সরকারকে সর্বোচ্চ দোষারোপ করা হয়েছিল যে, পূর্বের সরকার রাষ্ট্রকে ভারতের কাছে একপ্রকার বিক্রি করেই দিয়েছে। যদিও এক বছর পূর্তিতেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি প্রমাণও জনমানুষের সামনে আনার হীম্মত রাখেনি। উল্টো বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই সেই সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আছে। এই যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই সার্বভৌমত্বের প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আছে, সেখানেই পাঁচ আগস্টের নির্মম আত্মহত্যার উপসর্গ ধীরে ধীর সরকারের দ্বারাই প্রকাশ ঘটছে। যা এই এক বছর পূর্তিতে নানান প্রশ্ন জনমানুষের মনে উঁকি নিশ্চিত দেয়।
কেন এমন হলো? বহুবার লিখেছি আপন মত। পাঁচ আগস্টের অভ্যুত্থান শতভাগ প্রমাণীত যে, “পাঁচ আগস্ট রাজনৈতিক অভ্যুত্থান নয়। ইহা স্পষ্টতই ষড়যন্ত্রের অভ্যুত্থান ছিল”। অভ্যুত্থানকে শতভাবে রাজনৈতিক রূপে রাখতেই ষড়যন্ত্রকারীরা বেশ দক্ষতা দেখিয়েছিল, এটা স্পষ্ট এবং সাধারণ জনমানুষেরা ঘূর্ণাখোরেও ষড়যন্ত্র অনুমানে নিতে সক্ষম হয়নি। জনমানুষের হৃদয়ে থাকা দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে ষড়যন্ত্রের কারিগরেরা বেশ কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিল। এটা আজকের দিনে জলের মতন পরিষ্কার বলেই দেখছি।
আজ থেকে এক বছর পূর্বে ঘড়ির কাটা ফিরিয়ে দেওয়া গেলে অভ্যুত্থানের রূপটি একেবারেই ভিন্নতর হয়ে যাবে যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জনমানুষের ফিশফাশেই প্রমাণ হয়। আরও প্রমাণ হয় যে, অভ্যুত্থানে সশরীরে উপস্থিত থাকা দৃঢ়চেতা শতজনের প্রকাশ্য নানান বচন- বাচনে। এমনকি তবুও অভ্যুত্থানের ফসল জনমানুষের ঘরে তুলে দেবার প্রয়াশে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর বচন- বাচনেও বহুকিছুই প্রমাণ হয়ে সামনে চলে এসেছে।
পাঁচ আগস্ট অভ্যুত্থানের পিছনে ষড়যন্ত্র থাকা স্বত্বেও এই অভ্যুত্থানকে সাধারণ জনমানুষেরা শতভাগ নিজেদের ভেবে নিত যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার নিম্নেরপক্ষে “প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে” কিছুটা সক্ষমতা দেখাতে পারতেন। স্মরণে রাখুন, সাধারণ জনমানুষেরা বিনা বাক্যে ইউনূস সাহেবকে সর্বাত্মক ক্ষমতার চর্চা করার অধিকার দিয়েছিল কিন্ত। যা বিশ্ব ইতিহাসে খুঁজে পাওয়াটা সত্যিই অসম্ভব বটে। তবে চরম আফসোসের যে, সাধারণ জনমানুষের চাওয়া- পাওয়ার ধারেকাছে না গিয়ে, উল্টো শুরু থেকেই নিজের প্রতিষ্ঠানে বেশি নজর রাখা, অযাচিত স্বাধীন দেশের নির্ধারিত বিষয়গুলোকে অপমান- অপদস্থ করে প্রশ্নবিদ্ধ করে ছুটা, কোন এক অজানা স্বার্থকে প্রশয় দিয়ে (ধারণা হয় বা অনেকটাই প্রমাণীত) সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে এগিয়ে যাওয়া ইত্যাদিতে এতটাই জড়িয়ে যে অতঃপর রাষ্ট্রটিকেই আজ হযবরল করে ছুটছেন। এটা স্পষ্ট যে, এই রাষ্ট্রটি আজকের দিনে একটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক চরিত্র বহন করছে না।
শেষে এসে বলতেই হয়, ষড়যন্ত্র থাকা স্বত্বেও পাঁচ আগস্টকে জনমানুষের চাওয়া- পাওয়া বা আকাঙ্খায় যদি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার মূল্যায়ন করে এগিয়ে যেতেন তাহলে ষড়যন্ত্রকেও অনায়াসেই ময়লারভাগারে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, বিশ্বের সম্মানীত ইউনূস সাহেব এই বাংলাদেশের জনমানুষের হৃদয়েও চিরজীবী হয়ে যেতেন। আফসোসের যে ইউনূস সাহেব শুরু থেকেই সেই পথে হাঁটেননি এবং ফলাফল প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি শতভাগ শূণ্য।
আরও স্পষ্ট করে লিখছি, এই পাঁচ আগস্টকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইউনূস সাহেব ও উনার উপদেষ্টা পরিষদের সকলে মিলে, সকল ক্ষমতা ও সুযোগ হাতে রেখেই সর্বোচ্চ অপমান ও অসম্মান করেছেন। সুতরাং এর জবাবে একদিন ইউনূস সাহেবকে কাঠগড়ায় উঠতেই হবে এবং সেটা কিন্ত আওয়ামীদের কথা বলছি না, সাধারণ জনমানুষেরাই একদিন এমন উপলব্ধিতে আসবেই আসবে। স্মরণে রাখুন, সার্বভৌমত্বের আগুনে বহু লেলিহান হয় কিন্ত। বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডের ইতিহাস দেখুন, সার্বভৌমত্বের আগুনের তাপ ইতিহাসের পাতায় পাতায় অনুভব হবে।
বুলবুল তালুকদার
সমসমাজ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য
সমসমাজ.কম