বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন

সংবিধান, গঠনতন্ত্র, সনদ যাই বলেন অবশেষে জনগণই আসল সত্য 

বুলবুল তালুকদার 
সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

“খোলা জানালা”- সনদ শব্দটির আক্ষরিক বাংলা অর্থ দলিল বা প্রমাণপত্র। সংবিধান কি? কোনো রাষ্ট্র বা সংগঠনের পরিচালনার মৌলিক নীতি যা মূলত বিধি ও আইনের সমষ্টি। সহজ ভাষায় সরকারের ক্ষমতা ও কর্তব্য নির্ধারণ করে এবং জনগণের অধিকার নিশ্চিত করে। সংবিধান একটি রাষ্ট্রের আইনি ও রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। সংবিধান লিখিত বা অলিখিত, দুটোই হতে পারে। মূলত এগুলো সবার জানা বিষয় তবুও লেখার বিষয়বস্তুর কারণেই উল্লেখ করা মাত্র।
গঠনতন্ত্র কি? গঠনতন্ত্র হলো কোনো রাষ্ট্র, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের নিয়মকানুন বা বিধিমালা। যা রাষ্ট্রের ক্ষমতা, কার্যাবলী ও পরিচালনা পদ্ধতি নির্ধারণ করে।
মূলত সংবিধান ও গঠনতন্ত্র একই মূদ্রা। দুটোই প্রণয়ন করতে হয়। দুটো যখন মূলত একই বিষয় তহলে কেন ভিন্নভাবে লিখলাম? কারণ আপনারা নিশ্চয়ই দেশের উল্লেখযোগ্য বিশেষ চিন্তাবিদদের বচনে পাঁচ আগস্টের পরে বহুবার শুনে থাকবেন, দেশে একটি নতুন গঠনতন্ত্র তৈরী করতে হবে। নাম নাইবা লিখলাম, কে বা কারা এটা বেশ বলেন? এবং আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন।
মূলত এই বলার মাঝে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত আছে। সেই উদ্দেশ্যটি হলো, যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশের সংবিধান ছুড়ে ফেলাতো আর সহজ বিষয় নয়। তাছাড়াও এই স্বাধীন দেশের সংবিধান দ্বারাই এতদিন দেশ পরিচালনা হয়ে এসেছে এবং মাত্র ৫৪ বছরে শত বাঁধা পেরিয়ে দেশ যে খুব বেশি খারাপ এগিয়েছে, তাও নয় কিন্ত। সংবিধান মানা বা না মানায় বহু ব্যত্যয় ঘটেছে তবে সংবিধানের একেবারে বাহিরে গিয়ে বহু কিছুই ঘটে গেছে, তা কিন্ত মোটেও নয়। যেহেতু আমাদের দেশটি নতুন দেশ এবং গণতন্ত্রের চর্চা বলতে নিম্নমানের চর্চা হয়ে এসেছে, ঠিক সে কারণেই সংবিধান না মানার বহুবার ব্যত্যয় ঘটেছে। ওটা ভিন্ন আলোচনা।
যেহেতু পাঁচ আগস্টে একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি সরকারের পতন ঘটেছে এবং যেহেতু এখন রাষ্ট্রের বিশেষ গোষ্ঠীর হাতেই ক্ষমতা উঠেছে, সেহেতু বচন- বাচনে দেশের বিশেষ বিশেষ চিন্তাবিদদের নানান চিন্তাধারা, নানান শব্দ ও অভিধানিক অর্থ ধরে, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ সংবিধান আশা করছে এবং সেই বিশেষ সংবিধান মানে যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশের সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে, নতুন তৈরীর নামে, একটি গঠনতন্ত্রে এগুতে চায়। সে ক্ষেত্রে সংবিধান না বলে, গঠনতন্ত্র বললে দেশের জনমানুষের ভাবনায় হয়তো নতুন কিছু মনে হলেও হতে পারে। তবে বিষয়টি মোটেও অত সহজ নয় বলেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এখানে আরও একটি বিষয় অনাকাঙ্খিতভাবেই জুড়ে গেছে। মূলত একটি বিশেষ আন্দোলন থেকে পূর্বের সরকারের বিরুদ্ধে দেশের জনমানুষদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই, একটি অভ্যুত্থান দ্বারা সরকারের পতন ঘটেছে। তবে কোনভাবেই ওটা কোন বিপ্লব ছিল না। কোন সংজ্ঞায়নেই ওটা বিপ্লব ছিল না। কেননা মাত্র তিন সপ্তাহেই আর যাই ঘটুক, কোন রাষ্ট্রে বিপ্লব ঘটে না এবং পাঁচ আগস্ট তাই কোন বিপ্লব ঘটেনি। ইহাই সত্য।
লক্ষ্যণীয যে, বিপ্লব ঘটেনি বলেই দেশের বহাল সংবিধানের আলোকেই ১০৬ ধারা অনুযায়ীই সুপ্রিম কোর্টের একটি পরামর্শ বা পর্যালোচনার আলোকেই নতুন সরকার ক্ষমতায়ন হয়েছে (আজকের আলোচনা সংবিধানের ১০৬ ধারা বা সংবিধান লঙ্ঘন কিনা, এগুলো নয়)। সরকার যাত্রা শুরু করলো এবং জনমানুষের সবার, বলাই বাহুল্য দেশের বেশিরভাগ জনমানুষের সমর্থনেই বেশ শক্তভাবেই সরকারের সাথে ছুটলো।
যদি লক্ষ্য করে থাকেন, দেখবেন শুরুতে সংবিধান বা বিপ্লবী সরকার, এগুলো কিন্ত আলোচনায় আসেনি। যা বারবার সামনে এসেছে, তা হলো সংস্কার এবং সরকার সংস্কারের দিকে ঝুঁকে বেশি। তবে সমস্যা মূলত সেখান থেকেই শুরু। সংস্কার হবে কি করে? কেননা সরকারতো সংবিধান মেনেই সরকার হয়েছে এবং সংবিধান বলে ‘এভাবে- ওভাবে’ সংস্কার হবে। সংবিধান কিন্ত আরও বলে, ১০৬ ধারার অপব্যবহার হয়েই সরকার গঠন হয়েছ। মানে সংবিধানকে লঙ্ঘন করেই সরকার গঠন হয়েছে। আমি বলছি না। খোদ সংবিধান বলছে। আপনাদের স্মরণ থাকার কথা যে, ঐক্যমত কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা আলী রীয়াজ সাহেব নিজেও কিন্ত স্বীকার করেছেন, সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। সমস্যাটি ঠিক সেখানেই, মূলত। এই মূল সমস্যা সাথে নিয়েই সংবিধানের আলোকেই পথ খুঁজে নেওয়া ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় নেই। নেই মানে একেবারেই নেই।
উপরের কথাগুলো কেন উল্লেখ করলাম? কারণ ওই সনদ। সনদকে একপক্ষ সংবিধানের উপরে জায়গা দিতে মরিয়া। আবার আরেকপক্ষ বেশ জেনে বুঝেই হোক অথবা ভবিষ্যতের প্রশ্নেই হোক কিংবা সংবিধানের স্বার্থেই হোক, সংবিধানের সাথেই এগুনোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সনদকে যদি সংবিধানের উপরেই জায়গা দেওয়া হয় তাহলে সংবিধান বলে কিছুই থাকে না যে। আবার লিখছি সরকার এই সংবিধানের আলোকেই ক্ষমতায় বসে আছে যে।
পত্রিকাতে খবর দেখলাম ঐক্যমত কমিশন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিকট সনদ ও সংবিধান নিয়ে পরামর্শ করতে গিয়েছিলেন। ঐক্যমত কমিশনের প্রস্তাব ছিল, “সনদে যা লেখা থাকবে, সেটার উপরে আদালতের কোন রায় চলবে না এবং এই সনদের কোন ধারা যদি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সনদ চলবে, সংবিধান চলবে না”। বিষয়টি যতটা হালকা মনে হচ্ছে, মোটেও তা নয়। কেননা এর সরাসরি অর্থ হয় সংবিধান সনদের সামনে মূল্যহীন অর্থাৎ সনদ অল ইন অল। তাহলে প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের সংবিধান কোন প্রয়োজনে?
লক্ষ্যণীয যে, কোর্টের অধিকার থাকবে না সনদের বাহিরে যাবার। যেমনটা কোর্ট সংবিধানের আলোকেই চলে। এই ক্ষেত্রে তেমনটাই সনদের আলোকেই চলতে হবে। আরও লক্ষ্য করুন, এই কোর্ট সংবিধানের বহু সংশোধনী কিন্ত বাতিল করে দিয়েছে। সনদ বলুন বা সংবিধান বলুন বা গঠনতন্ত্র বলুন অবশেষে রাষ্ট্রের আদালতেই বিচার হয় এবং সেই বিচারে রাষ্ট্রের আদালত ওই সংবিধান/ সনদ/ গঠনতন্ত্র যেটাই থাকুক, সেটার আলোকেই বাতিল করার ক্ষমতা রাখে যে। এমনকি সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েও যদি সনদকে (যদিও সব রাজনৈতিক দল শব্দটি সঠিক নয়, এখানে) ঐক্যমত কমিশন যেভাবে চাচ্ছে, সেভাবেই সংবিধানের উপরে জায়গা দেয় তাহলেও ভবিষ্যতে কোন কাজেই আসবে না কারণ যদি রাষ্ট্রের কোন একজন নাগরিক বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করে, সে ক্ষেত্রে আদালত আবার ওই সংবিধান/ সনদ/ গঠনতন্ত্র যাই বলি, ওটার ভিত্তিতেই এই সংস্কার বাতিল করে দিতে পারবে।
আরও একটি বিষয় পত্রিকার খবরে দেখেছি, সনদের পক্ষে গণভোট নিয়েও কথা হয়েছে এবং সেই গণভোটের বিষয়ে বিএনপির প্রতিনিধিত্বকারী নেতা সালাউদ্দিন সাহেব সহমত হয়েছেন। ধারণা হয় এই সনদকে যে কোনভাবেই হোক মূল্যায়ন করার একটি চেষ্টা চলছে এবং হোক সেটা তাতে কোন অসুবিধেই নেই কেননা এই অভ্যুত্থান বহু রক্ত যে। ওই গণভোট যদি হয় সেখানেও থাকবে জটিলতা কেননা সংস্কার নিয়ে যতটুক জানি সব বিষয়েই নোট অফ ডিসেন্ট (Note of descent) দেওয়া আছে যে।
লক্ষ্য করুন, এই নোট অফ ডিসেন্ট বিষয়টি বেশ ইন্টারেস্টিং বটে। রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতের পথ সুগম রাখতে চায় কেননা রাজনৈতিক দলগুলো বেশ জানে যে, ভবিষ্যতে যদি আবার জনমানুষেরা ভিন্ন মতে পৌঁছায় তাহলে এই সব সংস্কারের কিছুই নাও টিকতে পারে। সেখানেই জনমানুষের সমষ্টিগত মতামতের বিষয় যা মূলত গণতন্ত্র। ঠিক যেমনটা ঐক্যমত কমিশনের চাওয়া সনদ ইজ অল ইন অল হোক কেননা সনদটা যদি অল ইন অল হয় তাহলে আপাতত সেটা হবে প্রস্থান রাস্তা (exit point)। কেন আপাতত শব্দটি লিখছি? সনদকে যখন সংবিধানের উপরে জায়গা দেবার চেষ্টা হয় তখন প্রশ্নটা কিন্ত বিনা প্রশ্নে প্রস্থানের বিষয়েই উঠবে।
বলাই বাহুল্য যে, যারা বা যে সকল রাজনৈতিক দল বা ঐক্যমত কমিশন কিংবা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সবার প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যেই একপ্রকার পক্ষপাত বেশ লক্ষ্যণীয হয়। সবাই সবার আপন ধান্ধায় পথ খুঁজছে বলেই প্রতিয়মান হয়। কেন এভাবে বলছি? কারণ একদিকে অভ্যুত্থান, অন্যদিকে বিপ্লবী সরকার নয় আবার বহাল সংবিধানের আলোকেই সরকার গঠিত হয়েছে, প্রশ্ন রয়েই যায় ১০৬ ধারা নিয়ে, ঐক্যমত কমিশন প্রধান নিজেই আবার উল্লেখ করেছেন গণমাধ্যমের সামনে সংবিধান লঙ্ঘন করেই ক্ষমতায়ন হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি নানান জটিলতায় একপ্রকার খিচুড়ি হয়ে আছে সব মিলিয়ে। এই খিচুড়ি কিভাবে হজম করা যায়, সেটা নিয়েই চলছে মূলত প্রতিযোগিতা। এভাবে বললেও খুব বেশি ভুল হবার নয় বলেই মনে করি।
কঠিন বাস্তবতা হলো বিপ্লব করার উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের পতন ঘটেনি। সরকারের পতন ঘটেছিল মূলত (আবার লিখছি) জনমানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কেন্দ্র করে এবং একটি বিশেষ দাবী থেকে সামগ্রিকভাবে জনমানুষের দ্বারা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই। যেহেতু বিপ্লব ঘটেনি এবং সহজ বাংলায় সে কারণেই বিপ্লবী সরকারও আসেনি। যদি তেমনটা ঘটতো তাহলে আজকের দিনে এই খিচুড়ি হতো না। এই সত্য মেনে নেওয়াটাই সঠিক বলে মনে করি। এখানে উল্লেখ করতেই হয় একটি রাষ্ট্রে বিপ্লব ঘটলে প্রতিবিল্পবও ঘটতে পারে ( এটা স্রেফ স্মরণ করার জন্য বলা/ বিপ্লবের ইতিহাস থেকে)। সব শেষে মূলত জনগণ থাকে সকল কিছুর কেন্দ্রে। হোক সেটা বিপ্লব বা অভ্যুত্থান বা গণ আন্দোলন।
শেষে এটাই বলবো, এই যুদ্ধ জয়ী স্বাধীন দেশটির উপর দিয়ে মাত্র ৫৪ বছরেই বহু ঝড়ঝাপটা গেছে। এই ঝড়ঝাপটার পিছনেও ওই জনগণই মূলত উপসর্গ। আমি ‘দোষ’ শব্দটি ইচ্ছাকৃত লিখলাম না। মূলত প্রতিপাদ্য বিষয় হলো দেশটিকে শান্ত হতে দিতে হবে। তা না হলে দেশটি যতদূর এগিয়েছে (বাস্তবিক সত্য হলো এই দেড় বছরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে বহু পিছিয়েছে/ আজকে ওটা আলোচনার বিষয় নয়), যদি দেশটি শান্ত না হয় তাহলে নতুন করে ঝড়ঝাপটা আসবেই আসবে। যা হয়তো সামাল দেওয়া কঠিন থেকেও কঠিনতর হয়ে উঠবে।
এখনও স্বপ্নের শেষ হয়ে যায়নি। তবে হ্যা দেশটিকে যদি শান্ত করতে হয় তাহলে সকল গোষ্ঠী, সংস্থা, অভ্যুত্থানকারী, রাজনৈতিক দল এবং সরকার অর্থাৎ সকল স্টেকহোল্ডারদের (Stakeholders) বাস্তবিক শুভবুদ্ধির উদয় হতেই হবে এবং সকলকেই একপ্রকার স্বার্থপরতার বড় বলিদান (Sacrifice) দেবার মানসিকোআ থাকতেই হবে। অবশ্যই সেটা রাষ্ট্রের সকল জনগণদের সামনে সেই সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের। অবশেষে যদি রাষ্ট্রের শতভাগ জনগণের দ্বারা সিদ্ধান্ত আসে তবেই রাষ্ট্রটি শান্ত হবে। নতুবা লম্বা পথ পাড়ি দেবার কোন পথ সৃষ্টি হবার নয়। এই রাষ্ট্রের প্রতি দয়াবান হয়ে বড় মানসিকতার সাথে সবাই ভাবুন। তবেই মঙ্গল।
বুলবুল তালুকদার 
সমসমাজ পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য 
সমসমাজ.কম 


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!