বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন

নন্দিনীর মৃত্যু এবং পূজায় মদ- গাঁজার আসর না বসানোর রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপন – অপু সারোয়ার

অপু সারোয়ার
রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

এক

” বান্ধবীদের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত মদপান, ঢামেক শিক্ষার্থী নন্দিনীর করুণ মৃত্যু ” , ” পূজায় মদপান, অকালে ঝরে গেল ঢাকা মেডিকেলের সেই মেধাবী নন্দিনী ” এই জাতীয় সংবাদ শিরোনামে দেশের প্রধান প্রধান দৈনিক গুলো সয়লাব হয়ে যায় ০৬ অক্টোবর থেকে পরবর্তী ২/৩ দিন। সংবাদ গুলোতে নন্দিনী রানী সরকারের ফটো ও পরিবার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, বাবা- মায়ের ফটো প্রকাশ করা হয়েছে। এই সংবাদের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ” পূজায় মদ পান ” নারী বিদ্বেষী, প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে হিন্দু বিরোধী মনোভাব উস্কে দিচ্ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ম্যাধমের সারাংশ হচ্ছে নন্দিনী রানী সরকার ২০২৪-২৫ সেশনের ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) শিক্ষার্থী ।নন্দিনী রানী সরকার। দুর্গাপূজা উদযাপনের জন্য ঝিনাইদহে আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিলেন। পূজায় ঘুরতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপানের পর নন্দিনী অসুস্থ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ঝিনাইদহ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়ায় নেওয়া হলেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। গত ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রকাশিত সংবাদের পিছিয়ে নন্দিনী সরকারের পিতার অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কথা ছত্রেছত্রে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। যে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনায় সেই পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে সেই পরিবারটিকে ছোট করা। শ্রেণী বৈষম্যকে সামনে নিয়ে আসা। একজন অটো রিক্সা চালকের সন্তান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়াকে বিশেষ ভাবে পরিস্ফুটিত করা হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে উঠে আসাকে সচেতন বা অবচেতন ভাবে মেনে নেওয়ার অপারগতা।

দুই

দূর্গা পূজা শুরুর আগে সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছিলেন ” সারাদেশে ৩৩ হাজার মণ্ডপে হবে দুর্গাপূজা, বসানো যাবে না মদ-গাঁজার আসর” । ধর্মীয় উৎসবকে মদ-গাঁজার আসর বলাটা চরম অশোভন ও অনুচিত। এ ভাষা প্রশাসনিক দায়িত্বশীলতার মধ্যে পড়ে না। পূজা মানেই মদ-গাঁজা এই ধারণা প্রচণ্ড অপমানজনক। এই বক্তব্য  হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতির উপর সরাসরি আঘাত ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উস্কে দেওয়া। কোনো নাগরিক জনসমাগমে বা ধর্মীয় অনুষ্টানেমাদক সেবন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া রাষ্ট্র ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। ব্যক্তিগত অপরাধের দায় কোনো উৎসব বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর চাপানো সম্পূর্ণ অন্যায়। ঈদ, বড়দিন , পূজা সহ অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবেও কেউ যদি  ব্যক্তিগতভাবে মদ বা নেশাজাত দ্রব্য সেবন করে, সেই অজুহাতে পুরো উৎসবকে কলঙ্কিত অন্যায়। কোন কালেই পূজা মদ-গাঁজার আসর ছিল না। এই জাতীয় বক্তব্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তোষণ ও হিন্দু বিষোদগারের চাষ। এই জাতীয়  হাজারো টুকরো টুকরো বক্তব্য থেকে গড়ে উঠে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা। এই সাম্প্রায়িক মনোভাব পূর্নদের কলমে / বক্তব্যে নন্দিনী সরকারের মৃত্য হয়ে উঠে  স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের ছায়া লিপি।

তিন

নন্দিনী সরকারের মৃত্যু নিয়ে  গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ গুলোতে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে।

( ১ ) কোন গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে নন্দিনী মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ” মদ্য পান ” এর ঘটনা ঘটেছে। কোন কোন গণমাধ্যম চাচার শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে এই ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। নন্দিনীর পরিবার মানিকগঞ্জে বসবাস করেন , মদ্যপানের ঘটনা ও অসুস্থতার ঘটনা ঘটে ঝিনাদহের শৈলকুপার কোন এক গ্রামে। যে পরিবারে থাকা অবস্থায় নন্দিনী অসুস্থ হয়ে পড়ে বা কথিত মদ্যপানের ঘটনা ঘটেছে সেই পরিবারের সাথে নন্দিনীর সম্পর্কটা সঠিক ভাবে বর্ণনার ব্যার্থতা দুঃখজনক। ঘটনার প্রাথমিক বিষয়কে খোঁজ খবর না নিয়েই রিপোর্ট করেছেন। যেকোন একটি রিপোর্ট হওয়ার পর অন্য গণমাধ্যম গুলো কিছুটা কাটছাঁট করে নিজেদের মত করে বাজারে অনলাইন ও প্রিন্টেড মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। পুরো বিষয়টি দায়িত্ব জ্ঞানহীন কাজ।

(২) গণমাধ্যমে নন্দিনী সরকারের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মদ্যপানকে উল্লেখ করা হয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের সাথে মদ্যপান করার অভিযোগ সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যদি বেশ কয়েক জন মিলে মদ পান করে থাকেন তবে শুধু নন্দিনী কেন অসুস্থ হয়ে মারা গেলেন। বিভিন্ন মানুষের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বিভিন্ন। বিষাক্ত মদের কারণে নন্দিনীর মৃত্যু হলে অন্য বন্ধুদের কেউ না কেউ বিষাক্ত মদের কারণে অল্প স্বল্প অসুস্থ হওয়ার কথা। নন্দিনীর মৃত্যর সংবাদ জানা গেলেও অন্য কোন বন্ধুর অসুস্থ হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় না। নন্দিনীর সঙ্গীদের কোনো তথ্য সামনে আসছে না, যা সন্দেহের জায়গা তৈরি করে।

(৩) যুগান্তরের ৬ অক্টোবর ২০২৫ নন্দিনী সরকারের মৃত্যু সম্পর্কে লিখছে ” বিজয়া দশমীর দিনে  [ ২ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার ] বিকেলে নন্দিনী তার বান্ধবীদের সঙ্গে প্রতিমা বিসর্জনে যায়। এ সময় সে তাদের সঙ্গে মদপান করে। গত বৃহস্পতিবার রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১২টার দিকে তাকে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার উন্নতি হলে ওই রাতই তাকে বাড়িতে আনা হয়। একদিন পর গত শনিবার [৪ অক্টোবর ] রাতে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেওয়া হয়। তখন চিকিৎসক তাকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে রেফার করেন। এরপর সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ রোববার [ ৫ অক্টোবর ] ভোরের দিকে তার মৃত্যু হয়। ”  একজন সাংবাদিক কোন রকম ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই কি ভাবে বলতে সমর্থ্য হলেন নন্দিনী মদ পানের কারণে অসুস্থ হয়েছেন। আমাদের সমাজে মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে নানা প্রকার ভুল ও অপতথ্য প্রচলিত আছে। এই অপতথ্যের উৎপত্তি ধর্ম।

পৃথিবী ব্যাপী প্রতিদিন কোটি লোক মদ – আলকোহলিক পানীয় বিনোদনের অংশ হিসাবে পান করেছে। এই  মদ – আলকোহলিক পানীয় পান করে মৃত্যুর সংখ্যা নেই বলেই চলে। আমাদের দেশ এর মত যে সমত দেশে নিয়ম নীতি ছাড়া মদ – আলকোহলিক পানীয়  বা ভেজাল খাদ্য তৈরী হয় সে সব দেশে বিভিন্ন সময়ে বিষাক্ত পানীয় পানে  মৃত্যুর কথা শোনা যায়। বাংলাদেশে সরকারের কর্মকর্তারা মদকে মাদক তকমা দিয়েছে এবং মদ খাওয়াকে সরকারীভাবে অপরাধীকরণ করা হয়েছে । এক দিকে মদ পানকে সামাজিক ও আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি দেশে বৈধ ভাবে মদ বিক্রি ও মুনাফা বেড়েছে। অপরিমিত মদ খাওয়া ভাল কিছু নয়।   রাষ্ট্র কতৃক ব্যক্তির উপর এই নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের জন্য একটি ফ্যাসিবাদী থাবা । বাংলাদেশে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ফলে দেশের অলিতে গলিতে অন্য নেশার আগ্রসন চলছে।পরিনিতে  মদের থেকে ক্ষতি বেশি হচ্ছে। দেশ ইয়াবা মাদকে চেয়ে গেছে। উল্লেখ্য ২০০৭/৮ সালের ১/১১ সামরিক সরকারের আমল থেকে মদকে মাদক তকমা দিয়ে এই অপকর্ম করা শুরু হয় এবং সেটা পরবর্তীতেও বজায় থেকেছে।

নন্দিনী সরকার যদি বিষাক্ত মদ খেয়ে মারা যেন তবে সে মৃত্য মদ পানের ৮/১০ ঘন্টার  মধ্যে হওয়ার সম্ভবনা শতভাগ। বৃস্পতিবার রাতে এক দফা হাসপালের ভর্তি ও রিলিজের পর মদের বিষক্রিয়া শরীরে থাকার সম্ভবনা নেই।  রোববার , ৫ অক্টোবর  মদের প্রভাবে মৃত্যুর প্রচারণা উদ্দেশ্য প্রনোদিত। দেশের হাসপাতাল গুলোর অবস্থা করুন। প্রয়োজনীয় লোক বল নেই , দক্ষ চিকিৎসকের অভাব কোন চিকিৎসা ছাড়াই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোর রেওয়াজ স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার স্বরূপ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় নন্দিনী সরকারকে দ্বিতীয় দফা শৈলকুপা হাসপাতলে ভর্তির পর কোন রকম চিকিৎসা না দিয়েই , ” উন্নত” চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়া হাসপাতালে রেফার / পাঠানো হয়। কুষ্টিয়া হাসপাতালে কোন রকম চিকিৎসা দেওয়ার আগেই নন্দিনী সরকার মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন। একটি সম্ভবনাময় জীবনের অবসান ঘটে। নন্দিনীর মৃত্যুর পূর্ববর্তী দুই দিনে তার অবস্থান সম্পর্কে কখনো মামাবাড়ি আবার কখনো চাচারবাড়ি বলে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে প্রতিকূলে নিয়ে যাচ্ছে। নন্দিনীর পরিবার ও পারিবারিক মন্ডলের বিভিন্ন সদস্যের মতামত ও চিকিৎসাসংক্রান্ত নিরপেক্ষ তথ্য না আসা পর্যন্ত অপ্রমাণিত বা বিকৃত খবর প্রচার অনুচিত । যথাযথ ডাক্তারি প্রতিবেদন ও প্রশাসনিক তদন্তের বাইরে কোনো কিছু প্রচার রাজনৈতিক ভাবে উদ্দেশ্য প্রনোদিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীদের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘জার্নালিস্টস উইথ ডিএমসি’ নন্দিনীর মৃত্যুর সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ডেকেছে। তবে এই চিকিৎসা শিক্ষার্থী গণমাধ্যমে নন্দিনী সম্পর্কিত প্রকাশিত মেডিক্যাল অপতথ্যকে মুখ খুলতে উদ্যোগী নন।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!