বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:৩৬ অপরাহ্ন

জুলাই সনদ: সংবিধান পুনর্লিখনের আড়ালে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা – অপু সারোয়ার

অপু সারোয়ার
বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

এক

১৭ অক্টোবর ২০২৫ জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই স্বাক্ষরের অন্তরালে ও প্রকাশ্যে বেশ কিছু রাজনৈতিক নাটকের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সনদের আলোকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশের সংবিধান,  বিচার বিভাগ,  আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগসহ রাস্ট্র্র পরিচালনার মৌলিক নীতি গুলো প্রণীত হওয়ার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করা হচ্ছে সাত দফা অঙ্গীকার নামাকে। সনদের অঙ্গীকার নামার দুই নম্বর ধারায় বলা  হয়েছে, এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।  আর তিন নম্বর ধারায় উল্লেখ আছে যে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ -এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করব না, উপরন্তু ওই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করব। ‘

অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনকারীদের হত্যা-নির্যাতনের মতো ঘটনায় প্রশ্ন যোগ্য বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইউনুস সরকার । কিন্তু  জুলাই-অগাস্টে অংশ গ্রহণকারীদের মধ্য থেকে যারা সহিংসতায় জড়িত , যারা মব সন্ত্রাসের সাথে যুক্ত তাদের বিচারের বাইরে রাখার প্রচেষ্টা করছে। কারও কোনো পদক্ষেপ অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হলে তার শাস্তি সবার জন্যই এক হওয়া উচিত।  বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা আইনসম্মত নয়। হাসিনা শেখের পতন ও পলায়নকে রাজনৈতিক ভাবে স্থায়ী উদযাপন করতে জুলাই সনদ তৈরি ও বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ৫ অগাস্ট ২০২৪ পর থেকেই চলে আসছে। এই নিয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক নাটক হয়ে গেছে।

দুই

শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ বিরোধিতার যথেস্ট যৌক্তিক কারণ আছে। তবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার নামে সংবিধান পাল্টে ফেলার যুক্তি অগ্রহণযোগ্য এবং দুরভিসান্ধিমূলক। স্বাক্ষরিত  জুলাই সনদ কোনো আইন নয়। এটা একটি রাজনৈতিক  বয়ান।  যা রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে তৈরি হওয়ার কথা। শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন  দেশের ইতিহাসের একটি বড় ঘটনা। ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ নাগরিকসহ বিপুল মানুষের অংশগ্রহণ ছিল হাসিনা পতনের আন্দোলনে। এই আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে যাত্রা শুরু করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। তবে হাসিনা পতনের পরের বিগত সকল সময় অব্যাহত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, মব সন্ত্রাস , দুর্নীতি , প্রধান উপদেষ্টার কর থেকে দায়মুক্তি , লাইসেন্স পারমিট নেওয়ার হিড়িক গণতন্ত্রের উত্তরণের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সরকারের আমলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল অর্জনের উপর আঘাত হানার মধ্য দিয়ে বেহাত গণঅভ্যুথানের দামামা বাজানো হচ্ছে। জুলাই সনদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানকে প্রতিস্থাপনের প্রথম ধাপ। পৃথিবীর কোন সংবিধানই পূর্ণাঙ্গ নয় । কোন সংবিধানে সকল কিছু সন্নিবেশিত করা সম্ভব নয়। অবাধ সুষ্ট নিবার্চন , মত প্রকাশের স্বাধীনতা , আইন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, কার্যকর ধর্ম নিরেপেক্ষতার অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টান গড়ে উঠা সম্ভব।

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিতর্ক, মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরাল, ভাস্কর্য – এমনকি জাদুঘরের ওপর হামলার মতো একের পর এক ঘটনা ঘটছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেই আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টের ‘দোসর’ বলে তকমা দেওয়া, সামাজিক মাধ্যমে হেনস্তা, এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণের অভিযোগ ব্যাপক হারে গণমাধ্যমে প্রকাশিত।

তিন

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৫২। বর্তমানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে। জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে জুলাই সনদ আলোচনায় ডাকা হয়নি। এসব দলকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ২৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের নেতারা অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১টি বাদে ২৪টি দল ও জোটের ৪৮ জন নেতা সনদে সই করেন। সনদে স্বাক্ষর করা নেতাদের দল ২২টি এবং জোট ২টি (১২–দলীয় জোট এবং জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট)। যে ২২টি দল সনদে সই করেছে, তাদের ৪টির নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন নেই। ১৮টির আছে। দুই জোটের যে চারজন নেতা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের তিনজনের দল নিবন্ধনহীন।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া ছয়টি দল সনদে সই করেনি ১৭ অক্টোবর । দলগুলো হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ ও গণফোরাম। গণফোরাম গতকাল অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও সনদে স্বাক্ষর করেনি। ” বাম ” দলগুলো সংবাদ সম্মেলন করে দলগুলো তাদের অবস্থান জানিয়েছিল। জুলাই সনদের প্রথম অংশে পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। সর্বসম্মত বিষয় ছাড়াও নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) দেওয়া প্রস্তাবগুলো সনদে যুক্ত করা হয়েছে। ৪ বামদলের  দেওয়া নোট অব ডিসেন্টগুলোর কারণও যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। ৪ বামদলের  সংশোধনী গুলো যুক্ত করা হয়নি। বাম দল বা গণ ফোরামের স্বাক্ষর না করার কোন রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে না। তবে ইতিমধ্যে ইউনুস সরকার “বামপন্থী ” দেরকে দলে ভেড়াতে তাদের দাবি মেনে নেওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এই দল গুলো যে কোন অজুহাতেই জুলাই সনদ স্বাক্ষর করতে আগ্রহী। তাদের দাবি মেনে না পূনাঙ্গ মেনে নেওয়ার না পরেও এই দল গুলো ইউনুস সরকারের পাশে ঘোরাঘুরির জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ও সেই লক্ষ্যে কাজ করছে।

চার

জুলাই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা এনসিপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করে হাসিনার পতনের পর। শুরু থেকেই এই দল ‘ কিংস ‘ পার্টি হিসাবে সমালোচিত। সারা দেশে মব সন্ত্রাসের সাথে প্রতক্ষ্য ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত এনসিপি । জাতীয় নাগরিক পার্টি – এনসিপি জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছে । এনসিপি  জুলাই সনদ সংশোধন, সনদকে স্থায়ীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত এবং জুলাই যোদ্ধাদের স্বীকৃতি- এই তিন দফা দাবিতে  অনুষ্টান বর্জন করেছেন । এই অনুষ্টানে শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছে। ” জুলাই যোদ্ধা ” নাম এনসিপির জমায়েতকৃত লোকজন অনুষ্টানে ব্যাপক ভাঙচুর করে। পুলিশের সাথে এনসিপির ” জুলাই যোদ্ধা ” দের সহিংসতা ঘটেছে।  ‘জুলাই যোদ্ধা’ ব্যানারে সংসদ ভবন এলাকায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশের লাঠিচার্জ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সংশোধন এনেছে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। এনসিপি – ” জুলাই যোদ্ধা ” দের  উদ্দেশে ক্ষমা চেয়ে ঐক্যমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন “আজ আপনাদের এভাবে দেখা করতে হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য শুধু লজ্জা, ক্ষোভের, দুঃখের বিষয় না; আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় রকমের পরিস্থিতি কখনোই আমরা মনে করি না।”

পাঁচ

জুলাই জাতীয় সনদে  বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাক্ষর করেছেন।  বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এই সনদকে ঐতিহাসিক অর্জন  হিসাবে বর্ণনা করেছেন। বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ছয়-সাতটা জায়গায় নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়ে রেখেছে। এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকারকে এটা পরিষ্কার করা দরকার যে প্রস্তাবিত গণভোটে যদি জুলাই সনদের পক্ষে রায় যায়, তাহলে ওই নোট অব ডিসেন্টগুলোর কার্যকারিতা থাকবে কি না। এত বিপুল সংখ্যক নোট অফ ডিসেন্ট কিভাবে মীমাংসিত হবে সেই বিষয়ে ইউনুস ও বিএনপি উভয়ই নিরব ।

এনসিপি জুলাই সনদের স্বাক্ষর করেনি। এই স্বাক্ষর না করা একটি পাতানো খেলা। ইউনুস সরকার নির্বাচন না করার একটি হাতিয়ার হচ্ছে এনসিপির কৃত্রিম বিরোধিতা। অন্য যে কোন দল বা গোষ্ঠী যে ইউনুস বিরোধিতা বা জুলাই সনদ বিরোধিতায় নামতে না পারে সেই কারণেই ” জুলাই যোদ্ধা ” দের বিরোধিতা। এনসিপি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করছে। ইউনুস সরকার কিংবা স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলের পক্ষে কোন আইনি ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব নয়। সংসদীয় পদ্ধতিতে সংসদ পারে একমত যে কোন কিছুর আইনি ভিত্তি দিতে পারে। সংসদের অনুপস্থিতে রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন দিয়ে কোন সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে পারে। তবে সংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে রাষ্ট্রপতির জারি করা প্রজ্ঞাপন গুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে , আইনি ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। তাই নির্বাচিত সরকার ভিন্ন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি সম্ভব নয়। জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার মাধ্যমে বিএনপি- জামাত ও বামপন্থিরা যৌথভাবে কাধে কাধ মিলিয়ে ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যাখান করলো। জুলাই সনদ  ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার আনুষ্ঠানিক দলিল! জুলাই সনদ সংবিধান পরিপন্থি এবং সাংঘর্ষিক। জুলাই সনদ  সংবিধান, স্বাধীনতাকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টা।

১৭ অক্টোবর ২০২৫-এ স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদ এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কেন্দ্রবিন্দু। কেউ একে গণতন্ত্রের পুনর্জন্ম বলছেন, কেউ আবার দেখছেন সংবিধান ধ্বংসের নীলনকশা হিসেবে। কিন্তু সনদটি যে নতুন ক্ষমতার স্থাপত্য নির্মাণের ঘোষণা— এ বিষয়ে রাজনৈতিক পরিসরে এক ধরনের অনুচ্চারিত ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। জুলাই সনদ একদিকে নতুন রাজনৈতিক ঐক্যের ভাষ্য, অন্যদিকে সংবিধানিক বিভাজনের সূচনা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তা এখন এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার ধারণা পুনরায় সংজ্ঞায়িত হচ্ছে।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!