শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৭ পূর্বাহ্ন

ঢাবি ক্যাম্পাসে হকার উচ্ছেদে ডাকসু

সমসমাজ ডেস্ক
শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

ঢাকা শহরে এক তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়, বিডিআর- বিজেপি স্থাপনা ও সেনানিবাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, হাকিম চত্বর ও আশপাশের এলাকায় প্রায় শতাধিক হকার অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেছেন। হাতে চিপস, চানাচুর, চা-কফি নিয়েও অসংখ্য হকার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেক শিশু-কিশোর হকার পানি বিক্রি করছে হেঁটে হেঁটে। এছাড়া টিএসসি ও ডাস চত্বরে একদল শিশু ফুলের মালা বিক্রি করছে, যাদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ক্যাম্পাস লাগোয়া বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হকার রয়েছে।

ঢাকা চট্টগ্রাম সহ সকল জেলা শহরে হকারীর উপস্থিতি এড়িয়ে পথ চলা কঠিন। প্রায় ফিবছর সরকার হকার উচ্ছেদের নাম বিভিন্ন রকম অমানবিক নিপিড়ন চালায়। এইনিপীড়ণের  মধ্যে রয়েছে চা বিক্রেতার ফ্লাক কেড়ে নেওয়া থেকে দোং দোকান ভাঙচুর করা। একজন হকারের জন্য এই হচ্ছে ‘পুঁজি – সম্পদ ‘ জীবিকার বাহন। শনিবার ,২৫ অক্টোবর অভিযান চালিয়ে ঢাবি ক্যাম্পাস থেকে অবৈধ দোকান, ভাসমান মানুষ এবং ভবঘুরেদের সরিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন উচ্ছেদ হওয়া একদল হকার। তাদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল বেশ কয়েকটি  ছাত্র সংগঠন। হকারদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে অল্প সংখ্যক  ছাত্র । প্রতিবাদী ছাত্রদের বক্তব্য ‘শিক্ষার্থীদের মানবিক হতে শেখানো, কিন্তু উচ্ছেদ অভিযানের নামে আজ যা করা হয়েছে তা অগ্রহণযোগ্য। দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে থাকা মানুষ ও হকারদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে উচ্ছেদ করা যায় না; এতে কোনো ইতিবাচক ফল আসবে না।’  অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ – ডাকসু ও হল সংসদ নেতারা প্রক্টরের কার্যালয়ের কাছে একটি পাল্টা সমাবেশ করেছে। তারা বামদল ও হকারদের সমাবেশের প্রতিবাদ জানান। হকারদেরকে অমানবিক ভাবে উচ্ছেদের প্রতিবাদী ছাত্রদের বিরুদ্ধে ডাকসু নেতৃবৃন্দ ও বিশ্ব খড়গ হস্ত। ঢাবি সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘জড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হবে। ক্যাম্পাসে কোনো অবৈধ দোকান থাকতে পারে না। হকারদের পক্ষে মিছিলে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাবি হকারদের উপস্থিতি কোন নতুন কিছু নয়। গত পঞ্চাশ বছর ধরেই ক্যাম্পাসে হকার রয়ে গেছে। প্রতিটি হল গেটে ৭/৮ টি টং দোকান আছে। রয়েছে রয়েছে ফুচ্কা সহ নানান ধরণের খাবার  বিক্রির ভ্রামমান টং দোকান। এই দোকান  গুলোর সাথে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েক হাজার পরিবারের বাঁচা – মরার সম্পর্ক। দেশের যে কোন জায়গায় হকার উচ্ছেদের জন্য সাধারণ ভাবে হকার বিরোধী প্রচারণা চালানো হয়। নগরের রাস্তা থেকে হকার উচ্ছেদের জন্য যানজট , হকার কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি , মাদক বিক্রি ইত্যাদি অভিযোগ প্রচার করা হয় । ঢাবিতে হকার উচ্ছেদের জন্য হকারদের বিরুদ্ধে মাদকের অভিযোগ এনেছে। হকারদের মধ্যে কেউ কেউ মাদক ব্যবসা বা মাদক সেবনের সাথে যুক্ত থাকার সম্ভবনা থাকতে পরে। তবে এ যাবৎ কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন হকার মাদক সেবক বা বিক্রির জন্য গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ চোখে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যদি মাদকের চাহিদা থাকে তবে হকার উচ্ছেদ করে মাদকের সাপ্লাই চেইন বন্ধ করার পরিকল্পনা অবাস্তব। মাদকের চাহিদা থাকলে যে কোন ভাবেই নতুন সাপ্লাই চেইন গড়ে উঠতে বাধ্য।

রাস্তা বা শিক্ষাঙ্গনে হকার না থাকলে ‘ পরিবেশ ‘ ভাল হতে পারতো ! কিন্তু হকার করা এবং কেনইবা দিন দিন হকারের সংখ্যা বেড়েই চলছে । হকার বৃদ্ধির সাথে দেশের বেকারত্ব বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে।  কাজের অভাবে মানুষ হকার বা রিকশা চালকের মত পেশায় ঢুকে পড়ে । বিকল্প কাজের ব্যাবস্থা না করে কোন ভাবেই হকার উচ্ছেদ সম্ভব নয়। বেকারত্ব, পেটের ক্ষুধার যন্ত্রনা মানুষকে হকারের জীবনকে বেছে নিতে বাধ্য করে। বেকারত্ব ও ক্ষুধার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশুনোর জায়গা  বা অবৈধ দোকানদারের কর্মসংস্থানের দায় ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের নয় এই জাতীয় ‘ভাল ‘ কথার মূল্য নাই।

ঢাবি ক্যাম্পাসে হকারের টিকে থাকার পেছনে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক বাস্তবতাও বড় ভূমিকা রাখে। অনেকে সীমিত আয়ের পরিবার থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রী, যাদের জন্য হকারের দোকানে বিক্রি হওয়া চা বা খাবারই বেশি সাশ্রয়ী। টং দোকানের চা দোকানের তুলনায় অনেক কম দামে পাওয়া যায়, যা সীমিত বাজেটের শিক্ষার্থীদের কাছে অপরিহার্য। অর্থাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ও হকারদের মধ্যে রয়েছে এক প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক নির্ভরতা। প্রশাসনের চোখে এটি ‘অবৈধ দোকান’, কিন্তু বাস্তবে এটি এক প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার কৌশল এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীর সাশ্রয়ী জীবনযাপনের পরিপূরক কাঠামো।

হকার উচ্ছেদ আসলে শুধু জায়গা খালি করা নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক রাজনীতি। সমাজের প্রান্তিক মানুষদের অপরাধী, অশুচি বা অপ্রয়োজনীয় হিসেবে উপস্থাপন করাই এই রাজনীতির মূল কৌশল। গরিবের দারিদ্র্যকে দেখা হয় নোংরা হিসেবে, তাদের সংগ্রামকে দেখা হয় অস্বস্তিকর সত্য হিসেবে। শোষণ ও বঞ্চনাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে টিকিয়ে রাখার সবচেয়ে পুরোনো রূপ এটাই—গরিবদের সমস্যা নয়, ‘সমস্যার মানুষ’ হিসেবে দেখানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানে এই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ সমাজের গভীর শ্রেণিবৈষম্যেরই প্রতিচ্ছবি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানী শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। এর মধ্য দিয়ে বা পাশ দিয়ে গেছে সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা।  ভেতরে রয়েছে মেট্রো রেল স্টেশন। জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা-প্রতিষ্ঠান শহিদ মিনার, বাংলা একাডেমী, জাতীয় যাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি, শিশু একাডেমী, ব্রিটিশ কাউন্সিল, ঢামেক, বার্ন ইউনিট, বুয়েট — সব এর পেটে বা গায়ে লেগে আছে।  বহিরাগতরা তাই এখানে আসতেই থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ই যদি জীবিকার প্রশ্নে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে প্রশ্ন উঠবে—এই প্রতিষ্ঠান কার জন্য? কেবল জ্ঞানের জন্য, নাকি ক্ষমতার শৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখার জন্য?হকার উচ্ছেদ কেবল দোকান ভাঙা নয়; এটি ভাঙে একটি সামাজিক সম্পর্ক, ভেঙে দেয় মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম আশ্রয়। এই শহরে, যেখানে মাথার উপর আকাশের জায়গাটুকুও বেচা-কেনা হয়, সেখানে হকারের ঠাঁই হয় না—কারণ তার অপরাধ, সে গরিব।

 


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!