বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৬ অপরাহ্ন

নতুন রাজনীতির সন্ধান …………….

ইমাম গাজ্জালী
রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০২৪

এক.

কোনো পরিবর্তনই চেনা পথে সংঘঠিত হয় না। সরল পথেও নয়। আগেকার সকল ব্যাকরণ ওলটপালট করে দিয়ে নতুন পরিবর্তন নিজস্ব পথ করে নেয়। একারণে প্রতিটি পরিবর্তনের থাকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, থাকে নিজস্ব সুমহান ঐতিহ্য। কোনো পরিবর্তনের নেতারা যদি অন্য কোনো পরিবর্তনের ঘটনাক্রম ও বৈশিষ্ট অনুসরণ বা অনুকরণ করতে যান, তাহলে তিনি জুতার মাপে পা ছেটে দেওয়ার কাজই করবেন। একটা দেশে আগের পরিবর্তনের কোনো কোনো ঐতিহ্য, গৌরব, আবেগ ও ভাবাদর্শকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে নতুন পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে। কখনও কখনও তা ছুড়ে ফেলে দেয়। কেউ যদি আগের পরিবর্তনের ঐতিহ্য, আবেগ, গৌরব ও ভাবাদর্শ শক্ত করে ধরে রাখেন, ধর্মীয় ভক্তিবাদের মত পুরানো পরিবর্তনের ঐতিহ্য, আবেগ, গৌরব ও ভাবাদর্শের গণ্ডি অতিক্রম করতে ব্যর্থ হন, তার পক্ষে পরবর্তী পরিবর্তনের সুরটি অনুধাবন করা সম্ভব হয় না। শুধু তাই নয়, তিনি পরবর্তী পরিবর্তনের ঘটনায় ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারেন। একই ব্যক্তি প্রথম পরিবর্তনে প্রগতিশীল, ঠিক তার পরের পরিবর্তনে প্রতিক্রিয়াশীল-এমন নজির ভুড়ি ভুড়ি। বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনে এমন বহু প্রগতিশীলের মন্তব্যে সেই প্রতিক্রিয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি আন্দোলনেই দেশি-বিদেশি নানা মহল তাদের নিজ নিজ স্বার্থে জড়িয়ে পড়ে, তা সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থান ঘটে আভ্যন্তরীন শর্তে ও শক্তিতে। শাসকরা প্রতিটি আন্দোলনেই বাইরের শক্তির ইন্ধন ও ষড়যন্ত্রের চিরাচারিত অভিযোগ করে থাকেন। যা ধোপে টেকে না।
একটি পরিবর্তনের অর্জিত ভাবাদর্শের শক্তি সেই সমাজকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে, সেটা কখনই অনাদিকাল পর্যন্ত নয়। একটা পর্যায়ের পর সেই অর্জিত ভাবাদর্শ পরিবর্তিত সময়কে আর ব্যাখ্যা করতে পারে না। পরিবর্তিত সময়কে ব্যাখ্যা করার জন্য আরেকটি ভাবাদর্শ সমাজ দেহে অনুভূত হয় এবং সেই ভাবাদর্শ নির্মাণের জন্য আরেকটি পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়ে। পরবর্তী ভাবাদর্শিক অর্জন পরবর্তী সময়কে আরেকটি পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়ার শক্তি ধারণ করে। কেউ যদি সেই আগের অর্জিত ভাবাদর্শকেই স্বতসিদ্ধ জ্ঞান করেন, তার অর্জনের সুমহান অংশে নিজেকে বিমোহিত রাখেন, তাহলে তার দ্বারা নতুন পরিবর্তনের সুর বোঝা সম্ভব না। মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শিক শক্তি সেই বাহাত্তর সাল থেকেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছে। কারণ আজ পর্যন্ত যে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা হয়েছে সেটা ছিল আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ, কখনই জনগণের মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান এখন পর্যন্ত নির্মিত হয়নি। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২-৭৫ এ জাসদ, সর্বহারা পার্টিসহ বেশ কিছু বামপন্থী দলের লড়াই সংগ্রামে একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল। নানা কারণে ওই সময় সেটা সফল হয়নি, এখন আবারও মুক্তিযুদ্ধেও গণভাষ্য নির্মাণের আরেকটি সম্ভবনা তৈরি হয়েছে।

No photo description available.

দুই

বাংলাদেশের ভিত্তি একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সুমহান ঐতিহ্য, গৌরব ও ভাবাদর্শের ওপরই বাংলাদেশের দাঁড়ানোর কথা ছিল। শাসকদের নানা কারসাজিতে সেটা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতারণমূলক ঐতিহ্য, প্রতারণমূলক গৌরব, ভুল বিবরণীর উপর। কারণ সেটা ছিল আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ। এদেশে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও অবস্থান করছে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বা অধীনে। বর্তমানে লড়াইত্যাগী জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টিও একই ধারায় লীন হয়ে আছে। অপরদিকে, কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদ প্রমুখ দল আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে জনগণের মুক্তিযুদ্ধেও ভাষ্য নির্মাণ করেনি। তাদের ভিন্ন কোনো ভাষ্য নাই এবং এ ব্যাপারে কোনো আয়োজনও নাই। একারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রতারণমূলক ঐতিহ্য, প্রতারণমূলক গৌরব, ভুল বিবরণীই স্বমহিমায় বহাল থাকছে, বর্তমানে যার ওপর নির্ভর করে দেশে দুঃশাসন জারি আছে। মুজিব শাসনামলে সর্বহারা পার্টির লিটেরেচারে শেখ মুজিবকে ‘জাতীয় বিশ্বাসঘাতক’ বলে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। ওই সময় জাসদের লড়াকু অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী ভাষ্য নির্মাণ বড় বাধার সৃষ্টি করে। কিন্তু বতর্মানে সেই বাধা দূর হয়েছে। কারণ সর্বহারা পার্টি খন্ডবিখন্ড ও বিলুপ্ত প্রায়, একই অবস্থা জাসদের। উপরন্তু দলটি স্বপক্ষ ত্যাগ করে শুধু নামটি ধরে রেখে, মুলত ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে’। এখন আওয়ামী লীগ নিজের মনের মাধুরি মিশিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখছে। আর বাধা দেওয়ার কেউ নাই। কিন্তু সঠিক বাংলাদেশকে পেতে চাইলে আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্য নির্মাণ জরুরি।
কারণ যে দলের প্রধান নেতার নামে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, সেই দলের প্রায় সকল নেতাকর্মীদের মুক্তিযুদ্ধে কোনো ভূমিকা ছিল না, এটা বলাই যায়। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোভাগে ছিল আওয়ামী লীগ এবং সে যুদ্ধে অনুপস্থিত থেকেও একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।’
(আজিজুর রহমান ও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভিত্তি’, ড. সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদিত), বাংলাদেশের ইতিহাস, ১ ম খন্ড, এশিয়াটিক সোসাইটি।)
একাত্তরে জনগণকে শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে অসহায় অবস্থায় রেখে নেতারা ভারতে পলায়ন করে। জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। শেখ মুজিবের অবর্তমানে তাজ উদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগের বাইরেও বিভিন্ন দল, গ্রুপ, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধশেষের দিকে ভারতফেরত মুক্তিযোদ্ধারা এসে সেই প্রতিরোধ যুদ্ধে সামিল হন। আওয়ামী লীগের নেতারা কলিকাতায় আনন্দ বিলাস স্ফুর্তিতে সময় কাটায় বলে অভিযোগ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। জনগণ স্বতস্ফুর্তভাবে প্রতিরোধ করতে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে তারা যুদ্ধ করেছে, কিন্তু কোনো দলের নেতৃত্ব বা দিকনির্দেশনা ছিল না। কিন্তু বামপন্থীদের মধ্যে বড় বড় শিক্ষিত, পরিশ্রমি আন্তরিক নেতা বা তাত্ত্বিক থাকলেও তারা জনগণের ভাষা বুঝতে সক্ষম হননি। এর আগে ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা স্বাধিকার আন্দোলন পাকিস্তানি ঐতিহ্য, ভাবাদর্শ ও রাষ্ট্র কাঠামোকে অতিক্রম করেনি। একই অভিযোগ ছয় দফার রাজনীতির বিরুদ্ধে থাকলেও ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থী অংশ একে অতিক্রম করে স্বাধীনতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। ভাসানীর পক্ষে এমন শক্তির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়নি। উপরন্তু, ভাসানীর স্বাধীকার আন্দোলন যখন একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে উপনীত হয়, ঠিক তখনই পার্টি বিভক্ত হয়, চীনপন্থী কমিউনিস্টরা তাকে পরিত্যাগ করে আর রুশপন্থীরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এই ফাকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা পরিপুষ্ট হতে থাকে। ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থীদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের তৈরি জমিন পেয়ে যায় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাজ উদ্দিনকে বরখাস্ত করেন, কোলে তুলে নেন মোস্তাক আহমেদকে। তিহাত্তরের নির্বাচনে কুমিল্লার মুরাদনগর আসন থেকে জিতেছিলেন জাসদের ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর রশিদ। তার প্রতিদ্বন্দ্বি খোন্দকার মোস্তাক আহমদকে জেতানোর জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে উড়িয়ে বঙ্গভবনে নিয়ে এসে গণনা করে। যথারীতি খোন্দকার মোস্তাক আহমদকে জিতিয়ে দেন। একই ভাবে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার একটি আসন থেকে তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে জেতানো হয়।
অপরদিকে, সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের যে অংশটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত করেছে, যুদ্ধে জনবাজি দিয়ে লড়েছে, সেই অংশকে শেখ মুজিব তার নেতৃত্ব কাঠামো থেকে বাতিল করে দেন, অনুমোদন দেন আপন ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির অংশকে। তাজউদ্দিনের বিপরীতে মোস্তাক এবং সিরাজুল আলম খানের বিপরীতে শেখ মণিকে জায়গা দেন শেখ মুজিব। যাদের নিছন দুর্বৃত্ত বললেও কম বলা হবে। সেই দুর্বৃত্তদের ক্ষমতার কেন্দ্রের এনেই শেখ মুজিব বাংলাদেশের শাসনকাজ শুরু করেন। তিনি যখন বলেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ তখন হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে যায়। কারণ যিনি ‘সোনার লোকদের’ ছুড়ে ফেলে দিয়ে ‘চোরের খনি’দের দিয়েই তার শাসনকাজ শুরু করলেন, তিনিই যদি আবার এসব কথা বলেন, তাহলে হাসি চেপে রাখা আসলেই দুস্কর হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতিশীল অংশকে ক্ষমতার বাইরে রেখে দুর্বৃত্ত অংশকে নিয়ে যে ক্ষমতাকাঠামো তৈরি হয়, নানা রাজনৈতিক পালাবদলে সেই ধারাটিই বজায় রয়েছে, ব্যক্তিবদল হলেও সেই ধারটিই বহমান। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ মালেক গ্রুপ, মিজান গ্রুপ, বাকশাল-এমন নানাভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে এসে মালেক গ্রুপের আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। উল্লেখ্য, মালেক উকিল ছিলেন মুজিব নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রী সভার সদস্য।
বলা চলে বর্তমান আওয়ামী লীগ হলো, মোস্তাক-মণির আওয়ামী লীগ। যে অংশটি স্বাধীনতাই চায়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মোস্তাকের বিরুদ্ধে।  মুজিব হতার সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগ না থাকলে হয়ত, মুজিবের ছবির পাশে যদি আর কারো ছবি রাখার বিধান থাকত, সেক্ষেত্রে মোস্তাকের ছবিই শোভা পেত।
বর্তমান আওয়ামী লীগ যে সিরাজুল আলম খানের ভাষায় এন্টি লিবারেশন ফোর্স, এটা বোঝার জন্য তেমন গবেষণার দরকার নাই। সেই দল মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে জোর করে, অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকছে, আর সেটা সম্ভব হচ্ছে জাসদ ও বামপন্থী স্বপক্ষত্যাগীদের কারণে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান প্রতারণমূলক, এরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতি থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে। যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতারণার স্বরূপ উম্মোচন করতে পারতেন, তারাই এখন নৌকার মাঝিমাল্লা। এর বিপরীতে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নির্মাণ সাময়িক হোচট খাচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার পরপরই জাসদের পক্ষেই মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মাণ সম্ভব ছিল। আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ যখন অকার্যকর হয়ে গেছে, আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ যখন চরম প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে চলে গেছে, তখন সময় দাবি করছে, মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মাণের। আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের প্রতারণার স্বরূপ উম্মোচন করে, জনগণের মুক্তিযুদ্ধের বয়ান তৈরি এখন সময়ে দাবি। এর আগে স্বপক্ষত্যাগী সরকারি বামপন্থীদের গণশত্রু ঘোষণা করা দরকার। মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা ও গৌরব রক্ষার জন্য আওয়ামী লীগের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের পতাকা কেড়ে নেওয়া দরকার। এখনই।

তিন
মুসলিম লীগ বনাম আওয়ামী লীগ, মিল অমিল পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তি দানা বেধেছিল তখনকার পূর্ববাঙলায়। মুসলিম লীগের সুহরোওয়ার্দী-আবুল হাসিম এবং মওলানা আকরম খা-খাজা নাজিমু্িদ্দন প্রমুখের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলন অত্যাধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এর মধ্যে মুসলিম লীগের সুহরোওয়ার্দী-আবুল হাসিম গ্রুপের ভূমিকা ছিল অগ্রগন্য। পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি হিন্দু তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষও সামিল হয়েছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনে। হিন্দু তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন বরিশালের যোগেন মন্ডল। তিনি তফসিলি সম্প্রদায়ের স্বার্থে মুসলিম লীগের সঙ্গে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে সামিল হন। নিপীড়িত হিন্দু মুসলমানের যৌথ আন্দোলনে পাকিস্তান আন্দোলন খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। বলা চলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পাঞ্জাবিদের চেয়ে পূর্বাবাঙলার বাঙালিদের অবদান বেশি।
কমিউনিস্ট পার্টিও সমর্থন দিয়েছিল। কমিউনিস্টরা মনে করত, পূর্ববাংলায় হিন্দু ব্রাহ্মন জমিদারের নিপীড়নে পিষ্ট মুসলমানরা যদি আলাদা আবাসভূমি পায় তাহলে সেই নিপীড়ন থেকে রেহাই পাবে। নিপীড়িতদের জন্য পাকিস্তান অন্তত মন্দের ভালো বলে মনে করে কমিউনিস্টরা।
ওই সময় কমিউনিস্টরা ধর্ম ভিত্তিক বিভক্ত ভারতের বিপরীতে, ভাষা ভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র সমূহের কনফেডারেশনের ঐক্যবদ্ধ ভারতের বিকল্প রাজনীতি হাজির করতে সক্ষম হননি। তর্কের খাতিরে বলা চলে, কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যদি পূর্ববাংলার মানুষ থাকতেন, তাহলে উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্রাহ্মন জমিদারদের নিপীড়ন এখনও বজায় থাকত। ব্রিটিশ থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি সত্ত্বেও ওই ভুস্বামীদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রত্যক্ষ করতে হত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার গরীব মুসলমান প্রজারা ও নিম্নবর্ণের গরীব হিন্দু প্রজারা হিন্দু ব্রাহ্মন জমিদারদের নিপীড়িন থেকে মুক্তির স্বাদ পায়।
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ সরকার সকল প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে। তারা যোগেন মন্ডলের সঙ্গে সকল চুক্তি ভঙ্গ করে। হিন্দুদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়, তাদের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে মুসলিম লীগের অকথ্য নির্যাতন। প্রতিষ্ঠার তিনবছর পর, ১৯৫০ সালে রাজশাহীর জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে গুলি করে ৭ জন কমিউনিস্ট কর্মিকে গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ৩১ জন। নাজিমউদ্দিন-নুরুল আমিনদের দিয়ে পূর্ববাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব সুহরোওয়ার্দী, আবুল হাসিমকে কোনঠাসা করে রাখে জিন্না লিয়াকতরা। মুসলিম লীগ প্রতিপক্ষের সঙ্গে যে যে কাজ করেছে, আওয়ামী লীগও ভিন্ন বাস্তবতায় একই কাজ করছে আরো নিষ্টুরভাবে।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, তার ধ্যানে জ্ঞানে ছিল পাকিস্তান। তিনি মনে প্রাণে পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছেন সেই পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য নয়। পাকিস্তান আন্দোলনের ঐতিহ্যে তিনিও বিমোহিত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সুহরোওয়ার্দীর কর্মী ও অনুসারি বা শিষ্য। সুহরোওয়ার্দী কখনই পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। তার শিষ্য হয়ে শেখ মুজিবের পক্ষে পাকিস্তান ভাঙার রাজনীতি সহজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন পথেই শেখ মুজিবকে হাঁটতে হয়েছে। হাঁটতে বাধ্য হতে হয়েছে। কারণ তখন এ ছাড়া তার সামনে আর বিকল্প ছিল না।
সুহরোওয়ার্দীর সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সম্পর্ক খুব শক্তিশালি অবস্থায় ছিল। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতি শেখ মুজিবের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়ে পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতির পথে হাটতে থাকেন। সুহরোওয়ার্দী বেঁচে থাকলে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ৬ দফা দেওয়া সম্ভব হত কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ আছে।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগের শাসকদের বা সামরিক শাসক জে. আইউবের অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বললেই, তাদের ইসলামের শত্রু, ভারতের দালাল, কমিউনিস্টদের চর বলা হত। অথচ এসব মানুষ কেউই ইসলামের শক্র ছিল না, ভারতের দালাল ছিল না এবং কমিউনিস্টদের চরও ছিল না। তারা শুধু বঞ্চনার কথাই বলত, প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাইত আর মুসলিম লীগ সরকারের অনাচারের কথাই বলত। ঠিক এখন যেমন আওয়ামী লীগের অনাচারের বিরুদ্ধে বললেই রাজাকার ট্যাগ দেওয়া হয়।
বিপরীতে মুসলিম লীগ সরকার মুসলমান বাঙালিকে কুৎসিত ভাষায় গালাগাল করত। আইউব খান বলতেন, বাঙালিরা ভালো মুসলমান নয়। যে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান আনল, তাদেরই এভাবে জাত তুলে কথা বলতো মুসলিম লীগ সরকার ও সামরিক সরকার। মুসলিম হিসেবে পাকিস্তান এনে, সেই মুসলিম পরিচয় নিয়ে শাসকদের কটাক্ষ, এতে আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমানরা। ইতোমধ্যে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তাদের সামনে আত্মপরিচয়ের নিশানা দিয়ে দেয়। ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে তারা ভাষা ও সংস্কৃতিকে তারা আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে খুঁজে পায়। জন্ম নেয় ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনা। এর আগে গোপনে গোপনে পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতা শুরু করেছিল কমিউনিস্টরা। তাদের হাত ধরেই ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনার ভিত্তি তৈরি হয়। হিন্দু তফসিলি সম্প্রদায় পাকিস্তানের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তারা বুঝতে পারে মুসলিম লীগ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। তাদের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পকিস্তানে তফলিসি হিন্দুদেরর আর জায়গা নেই, উচ্চবর্ণের হিন্দুদের তো নয়ই। সুতরাং তারাও ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য উঠে পরে লাগে। ফল মিলল হাতে নাতে। ভাষা আন্দোলনের দুই বছর পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। বিপরীতে আবুল কাসেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সুহরোওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট ভূমিধস বিজয় পায়। এইভাবে বাঙালিরা মুসলিম লীগের অনাচরের জবাব দেয় ব্যালেটে। ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দ্বিজাতি তত্ত্বকে নাকচ করে হিন্দু মুসলমানের মিলনের ভিত্তি তৈরি করে। কয়েক দশক ধরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে যে বিভাজন রেখা তৈরি হয়েছিল, ষাটের দশকের ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সেই বৈরীতা দূর করে। এটা মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির অন্যতম প্রধান অর্জন, পরবর্তী শাসকরা সেই অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়। যার যাত্রা শুরু হয় শেখ মুজিবের হাত ধরে। এই পর্বে ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনার উম্মেষ যে নতুন শক্তির উত্থান সূচিত করেছিল, পাকিস্তান আন্দোলনের মোহে আবিষ্ট কেউ যদি তা টের পেতে ব্যর্থ হন, তাকে রাজাকার হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নাই। ওই সময় যে নতুন শক্তির উত্থান সূচিত হয়েছিল, সে ব্যাপারে আহমদ ছফার বয়ান-
“বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশ-লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন, সে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। তাদের সাফল্যের পরিমাণ হয়ত আশানুরূপ ছিল না কিন্তু সূচনাটি করেছিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। সংস্কৃতিতে উত্তাপ, লাবণ্য এবং গতি সঞ্চার করার ব্যাপারে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা অনেক কিছু দিয়েছেন। সেই সব মহান অবদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
“বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত এবং মুকুলিত হয়। বাঙালী জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাদের জেল-জুলুম কম সহ্য করতে হয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ দলটির কাছ থেকেও তাদের কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি। পাকিস্তানের সংহতি বিনাশকারী, বিদেশি গুপ্তচর, ইসলামের শত্রু এই ধরণের অভিযোগ বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং  কর্মীদের বিরুদ্ধে হামেশাই উচ্চারিত হত। এসব লাঞ্ছনা সহ্য করেও বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরা রাষ্ট্রের ভ্রূণ রোপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেটুকু সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে করেন, তার পেছনে রয়েছে বামপন্থী রাজনীতির বিপুল পরিমাণ অবদান। বামপন্থী রাজনীতিই শ্রমিক-কৃষক-নিম্নবিত্তসহ সমস্ত নির্যাতিত মানুষকে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগঠিত করেছে এবং আন্দোলনে টেনে এনেছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বামপন্থী আন্দোলন এখন রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ উত্থানরহিত। বামপন্থী রাজনীতির মুমূর্ষু অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যকে তমসাচ্ছন্ন করে রেখেছে।” (সাম্প্রতিক বিবেচনায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, আহমদ ছফা। খান  ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, পৃ. ৩৫-৩৬)
এদিকে, ১৯৬৬ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক নাকি রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সঠিক- এই অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে অন্যান্য দেশের মত পাকিস্তানের কমিউনিস্টরাও বিভক্ত হয়ে পড়ে। যাদের হাত ধরে ভাষা ভিত্তিক আত্মপরিচয়ের নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তারাই তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই ফাকে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি চলে যেতে থাকে উঠতি বুর্জোয় দল আওয়ামী লীগের হাতে।
ঠিক এই সময় আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে ৬ দফা। ছয় দফা ঘোষণার পর রাষ্ট্রীয় রোসানল তৈরি হয়। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হন, আওয়ামী লীগের নেতারা গর্তে লুকায়। হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ধরতে গেলে একক উদ্যোগে সেই হরতাল সফল করেন সিরাজুল আলম খান। তিনি ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকদেরও ওই হরতালে সামিল করেন। বলা যেতে পারে এই হরতাল সফল করার একক কৃতিত্ব সিরাজুল আলম খানের।
ছয় দফা রয়েছে মূলত লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা। যেখানে উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ট এলাকায় একাধিক রাষ্ট্রসমূহের কনফেডারেশন গঠনের কথা রয়েছে। কিন্তু নিউক্লিয়াসপন্থীদের তৎপরতা ছয় দফাকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ, জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ, জাতীয় পতাকা তৈরি-ইত্যাদি ঘটনা ছয়দফার স্বাধীকারের গণ্ডি অতিক্রম করে, তাকে স্বাধীনতার দোর গোড়ায় পৌঁছে দেয়।
নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান সম্পর্কে ডা. আবু হেনা এক অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এক সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার জন্য যা করেছেন, আওয়ামী লীগের নেতারা তা জানেই না। জানলে তো স্বীকৃতির প্রশ্ন।’ উল্লেখ্য, ডা. আবু হেনা হলেন সেই ব্যক্তি, যাকে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে ভারতে পাঠিয়েছিলেন, সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।
অপরদিকে, শেখ মুজিবের এই কাছেকার লোকদের সম্পর্কে সিরাজুল আলম খান বলেছেন-
‘বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধকালীন সময়ের নেতা হলেন তাজউদ্দীন। জামাতে ইসলামী হলে পাকিস্তানী ফোর্স আর আওয়ামী লীগ ছিল এন্টি লিবারেশন ফোর্স। আওয়ামী লীগ তো ছয় দফা থেকে এক ইঞ্চিও আগে বাড়াতে চায়নি। এদের সত্যকার চেহার জানতে পারলে মানুষ এদের গায়ে থু থু দেবে। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় তাজউদ্দীনের নাম আসা উচিত এক নাম্বারে। অথচ তিনিই হলেন প্রথম ক্যাজুয়ালিটি।’
— জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি, পৃষ্ঠা ৭১। মহিউদ্দিন আহমদ।

চার

আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বনাম জনগণের মুক্তিযুদ্ধ।
সবাই জানে মুক্তিযুদ্ধকালে আওয়ামী লীগের মধ্যে ছিল দুইটি অংশ। একাংশের নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের নেতা। আরেকাংশের প্রতিনিধি খন্দকার মোস্তাক আহমেদ, যিনি যুদ্ধকালে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ার ষড়যন্ত্রের হোতা। তিনি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সন্দেহের তালিকায় ছিলেন। যাতে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারেন এজন্য গোপন নজরদারিতে ছিলেন খোন্দকার মোস্তাক আহমদ।
একইভাবে, ছাত্রলীগের মধ্যেও ছিল দুইটি অংশ। একাংশ স্বাধীনতাপন্থী, যার নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। আরেকাংশ স্বাধীকারপন্থী, যার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। মুক্তিযুদ্ধকালে মণির কাজ ছিল তাজ উদ্দিনের কাজে বাগড়া দেওয়া। একবার তাকে হত্যা করার জন্য মণি পিস্তল নিয়ে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাংলাদেশে নয়, ভারতের নাগা বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থী নেতা স্বপন কুমার কে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২৬ মার্চ ক্রাকডাউনের পর, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দৌঁড়ে ভারতে পলায়ন করে। স্বাধীনতার পর তারা দেশে ফিরে তারাই স্বাধীনতার একমাত্র সোল এজেন্ড বলে জোরেশোরে প্রচার করতে থাকেন। শেখ মুজিবের বদৌলতে ক্ষমতা থাকে। ব্যাপক চুরি ডাকাতি ছিনতাই রাহাজানিতে জড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি ২২ পরিবারের ফেলে যাওয়া সম্পদ লুটপাটে মেতে ওঠে। সেই সাথে বাদ যায় না বিহারি ও হিন্দুদের বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি দখল ও লুটপাট। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে বলা হত, স্বাধীনতাবিরোধী, পাক হানাদারদের দোসর ও রাজাকার ইত্যাদি।
আগেই বলা হয়েছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মোস্তাক-মণির আওয়ামী লীগের ধারা বিলং (নবষড়হম)  করে। তারা অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে জোর করে ক্ষমতায় আছে মুক্তিযুদ্ধের দোহাই দিয়ে। যত অপকর্ম করছে মুক্তিযুদ্ধের নামে। লুটপাট, অর্থপাচার, জনতার সম্পদ আত্মসাৎ, গুম খুন হত্যা করছে মুক্তিযুদ্ধের ‘বৈধতা’ শিকার করে। এখনও সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী , জামাত-বিএনপির দালাল বলে ট্যাগ করে দেওয়া হয়। যেমন পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বললেই ইসলামের শত্রু বলা হত। এসব ঘটনার যুৎসই জবাব মানুষ অতীতে দিয়েছে। প্রবাদে বলা হয়, বেশি চিপলে লেবু তেতো হয়। যখন তখন যাকে তাকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী, বিএনপি-জামাতের দালাল বলে বলে এসব ঘৃণাবাচক শব্দকে সহনীয় করে ফেলেছে।
ইতিহাসের ট্রাজেডি হলো, ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থীরা বাহাত্তরে আলাদা অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেও, তারা আওয়ামী লীগের বিপরীতে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হননি। যখন শেখ মুজিবকে অতিক্রম করার উৎকৃষ্ট সময়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বরত জাসদের প্রতিটি নেতাকর্মীর অন্তরজুড়ে তখনও ছিল শেখ মুজিব। শেখ হাসিনার অন্তরে ‘রাজনৈতিক শেখ মুজিব’ এর যতটা না শক্ত আসন রয়েছে, জাসদের হাসানুল হক ইনুর হৃদয়ে তার চেয়ে ঢেড় বেশি শক্ত অবস্থান রয়েছে শেখ মুজিবের। জাসদের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র পাওয়া যাবে। এখন দেখা যায়, শেখ মুজিব ছাড়া জাসদ জিরো। জাসদ ও আওয়ামী লীগ শুধু নামের প্রভেদ। অথচ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠায় জাসদ সক্ষম হলে মুক্তিযুদ্ধে মূল ধারা প্রবাহিত হত জাসদের খাতে আর আওয়ামী লীগের পরিণতি হত মুসলিম লীগের মত। জাসদ নিজেকে তিলে তিলে আত্মহনন করে আওয়ামী লীগকে তার বিপর্যস্থ পরিণতি থেকে রক্ষা করে দলটিকে একটি দানবে পরিণত করেছে। গুটিকয়েক সাবেক চীনাপন্থী বামসংগঠন ছাড়া এই কথা কমবেশি সকল বামপন্থী সংগঠনের ক্ষেত্রেও খাটে। একারণেই আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ওপর একচ্ছত্র মালিকানা তৈরি করতে পারছে।  আর সেই মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম
সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এতটাই অনমনীয় হয়ে ওঠে যে, আওয়ামী শাসকদের এসব ঘৃণাবাচক শব্দকে তারা আর আমলে নিতে রাজী হচ্ছে না। তত্ত্ব থেকে নয় বাস্তবতা দেখে দেখে তারা ‘আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ’র বয়ান গ্রহণ করছে না। প্রত্যাখ্যান করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা জামায়াত ঠেকানোর নামে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ’ রাজনৈতিক লাইনে আছেন, যারা সরকারের সমালোমূলক আন্দোলন করছেন উচ্ছেদের লড়াই করছেন না। প্রকারন্তে তারা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্যের নামে সরকারের ফ্যাসিস্ট আচরণকে সমর্থন করছেন, তারা এই তরুণ প্রজন্মের ভাষা বুঝতে অক্ষম।
এই তরুণ প্রজন্ম দেখেছে, মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া তালিকা, তালিকা অনুযায়ী ভুয়াদের মুক্তিযোদ্ধা সাজিয়ে ভাতা প্রদান এবং তালিকা থেকে বাদ পড়া স্বীকৃতিহীন প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা। এই প্রজন্ম দেখেছে, আওয়ামী লীগ করলেই একজন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধায় পরিণত হতে পারে বা ‘মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের’ শক্তি হতে পরে। আর আওয়ামী লীগ না করলে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা বিরোধী তকমা পায়। এই তরুণরা আরো দেখেছে, জামাতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের জোটবদ্ধ আন্দোলনে তথাকথিত প্রগতিশীলদের অবাক করার মত নীরবতা। আরো দেখেছে, মুক্তিযুদ্ধের নামে লুটপাট আর অরাজকতা আর ছাত্রলীগের সীমাহীন দৌড়াত্ম, টর্চারসেলের নানা অকথ্য নির্যাতন। তারা উপলব্ধি করেছে, আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ। সুতরাং তাদের দেওয়া রাজাকারের তকমা এই তরুণ প্রজন্মের কাছে মূল্যহীন।
মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণের বিরুদ্ধে, বিশেষত বর্তমানের তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে মুক্তিযোদ্ধারা যে মর্যাদায় আসীন ছিলেন, হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সেই মর্যাদা ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে অপমান করেছে।
এই সময়ের প্রজন্মের সঙ্গে তুলনা চলে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়কে ঘিরে একটি বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থান ঘটেছিল। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ওই প্রজন্মকে শিক্ষিত করেছিল। মূলত স্বাধীনতার রাজনীতি ওই ছাত্র তরুণদের অবদান। তাদের অভিভাবকত্বের ছায়া দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। এরপর নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলনের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। তার দুইযুগ পর ২০২৪ সালে আরেকটি অপ্রতিরোধ্য স্মার্ট তরুণ প্রজন্মের উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই শিক্ষার্থীদের দমাতে শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে গণহত্যা সংঘটিত করেছে, এতে এরশাদ কেন আইউব-ইয়াহিয়াও লজ্জা পাবে। ইতিহাসে এরশাদ তো বটেই, আইউব-ইয়াহিয়ার চেয়েও জঘন্য জায়গায় অবস্থান নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাসে শেখ হাসিনার জায়গা এখন ইয়াহিয়ার পাশে।
২০১৫ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কিশোররাই আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাঝখানে আরো কয়েকটি শিক্ষা বিষয়ক আন্দোলন হয়েছে। যেমন কোটা সংস্কার আন্দোলন, ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন ইত্যাদি। তাহলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, ভ্যাট প্রত্যাহার দাবির আন্দোলন ও বর্তমানে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন এই প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তুলেছে, ছাত্রলীগকে চিনিয়েছে। এতদিন অভিযোগ ছিল এই তরুণরা ইন্টারনেটে বুদ হয়ে পড়ে থাকে, এরা নিজের কেরিয়ার ছাড়া আর কিছু বোঝে না, এরা জাতির জনগুরুত্ব নিয়ে ভাবে না-ইত্যাদি। এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্রগণ অভ্যুত্থানের দুই যুগ পর আরেকটি অভুতপূর্ব ছাত্রগণ অভ্যুত্থানের ইতিহাস রচিত হল। শত শত আত্মত্যাগের মহিমায় আজকের তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসে অনন্য মর্যাদায় আসীন হয়ে থাকবে।
কিন্তু অতিশয় দুঃখের বিষয় হল, এখানকার ক্রিয়াশীল বামপন্থী ও প্রগতিশীলের প্রধান অংশ এই প্রজন্মেও ভাষা বুঝতে সক্ষম হননি। যখন পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে, শত শত ছাত্র তরুণ আত্মহুতি দিচ্ছেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও রাষ্ট্রের নিপীড়নে ক্ষুব্ধ ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যখন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমর্থন দিচ্ছে, একাত্ম হচ্ছেন। সরকারের প্রভাবে আদালত আন্দোলনের পক্ষে রায় ঘোষণা করল, তখন সেই রায় ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রথম বামপন্থীদের বিবৃতি দেখা গেল। আর সরকারপন্থী বাম বরাবরের মতই সরকারের নিপীড়নের পক্ষে জোড়ালো অবস্থান নিয়েছে। এদের গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার আর কোনো অজুহাতই বাকি থাকল না। ষাটের দশকের ও নব্বইয়ের ছাত্র আন্দোলনের অভিভাবক ছিল, কিন্তু বর্তমানের তরুণদের আন্দোলন অভিভাবকহীন। মওলানা ভাসানীর  মত ‘খামেশ’ বলার কেউ নাই।
আওয়ামী লীগের দানব হয়ে ওঠার পেছনে বামপন্থীদের দায় : ঘুরে ফিরে এখানকার  প্রায় সকল বামপন্থী শক্তিই সরকারপন্থী। জাসদ ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টি মেনন প্রভৃতি সরকারি বাম। তারা সরাসরি সরকারকে ও তার নিপীড়নকে সমর্থন করে যাচ্ছে। সিপিবি-বাসদ আধা সরকারি বাম, এরা মৌলবাদী জুজুর ভয়ে আকারে ইঙ্গিতে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আওয়ামী লীগ’ লাইনে রয়েছে। তাদের ভয়, আওয়ামী লীগকে সরালে পাছে মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটে। এই ভয়ে তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা করছে, তার অনাচারের নিন্দা করছে, কিন্তু উচ্ছেদের রাজনীতি করছে না। এই সরকারের টিকে থাকার পেছনে এসব বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছোট খাট দল ও গ্রুপের স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়ানোর সঙ্গতি নেই।
কিন্তু সত্যটা হল, এই আন্দোলনের পর সরকার যদি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে, তাহলে পঁচাত্তরের বাকশালী শাসনের আরেক রূপ দেখবে মানুষ। ফ্যসিবাদ কতপ্রকার ও কি কি, মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
এবারের পরিবর্তনর কি গতানুগতিক ধাচের হবে? : বাংলাদেশের ইতিহাসে যতগুলো পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সেখানে জীবনবাজী রাখা জনগণের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে শাসকদের উচ্ছেদ হয়েছে, বিজয়ী জনতা আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছে কিন্তু সত্যকারের পরিবর্তন বলে কিছু হয়নি। স্বপ্ন অধরাই থেকেছে। ঘুরেফিরে পুরানো শাসনব্যবস্থাই জারি থেকেছে, শুধু শাসক পাল্টিয়েছে। সাতচল্লিশ, ঊনসত্তর, একাত্তর, নব্বইয়ের ক্ষেত্রে এসব কথা প্রযোজ্য। এত এত উদাহরণের পরও কি মানুষ সেই পুরানো বিষবৃক্ষের গোড়ায় জল ঢালবে। বার বার একই ভুল করবে। একটি উন্নত, আধুনিক,  সেক্যুলার, বৈষম্যহীন, সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গড়ার সুনিদ্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়েই পরিবর্তনের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া ছাড়া পুরানো ভুল থেকে উত্তরণের উপায় কি? এমন প্রশ্ন পাশ কাটিয়ে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নাই। সত্যকার পরিবর্তন চাইলে এই শোষনমূলক ও লুণ্ঠনমূলক রাষ্ট্র বাতিল করতে হবে। প্রথমেই বাতিল করতে হবে সংবিধান।
অতি অবশ্যই নিন্মোক্ত কর্মসূচি থাকতে হবে-
১. ভুমি জাতীয়করণ, বৃহৎ খাদ্য ব্যবসা জাতীয়করণ, বৃহৎ কলকারখানা ও ব্যাংক বিমা জাতীয়করণ, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও গণপরিবহণের ব্যক্তিমালিকানা বাতিল। পর্যায়ক্রমে বেতনস্কেল সমান সমান করার উদ্যোগ নেওয়া।
২. দুর্নীতিবাজ, ধর্মব্যবসায়ী, জনগণের সম্পদ আত্মসাতকারীদের বিচার। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, ভোটাধিকার বাতিল ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা। উন্নয়নের নামে লুটপাটের বিচারকাজ শুরু করা।
৩. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সকল হত্য, গুম, নির্যাতন এবং ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন নির্যাতনে ঘটনার শ্বেতপত্র প্রকাশ, দোষিদের বিচারের আওতায় আনা।
৪. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পাদিত সকল গোপন চুক্তি প্রকাশ, অমর্যাকর গণবিরোধী চুক্তি বাতিল, ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা আদায়, সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ।
৫. নাগরিকের নিরাপত্তার বিধান, নারী পুরুষের সমধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিযুক্তি, নামে মাত্র মূল্যে নাগরিকের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও পরিবহনের ব্যবস্থা করা।
৬. বর্তমান সংবিধান বাতিল ও নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ গঠনের রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহন
শুধু শাসক বদলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা মানে ইচ্ছে করে পুরানো ভুলে আত্মহুতি দেওয়া। এই মুহুর্তেও করণীয় নিয়ে যঃঃঢ়ং://িি.িনধহমধৎধংযঃৎধ.হবঃ/ধৎঃরপষব/১৫১১.যঃসষ  এই লিঙ্কে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব দেওয়া আছে। আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
আত্মপরিচয়ের ঘাটতি প্রসঙ্গে : বাংলাদেশে বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে তিনটি শক্তি পাশাপাশি ক্রিয়াশীল। বুর্জোয় জাতীয়তাবাদী শক্তি, বামপন্থী শক্তি এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তি। যা এখনও ক্রিয়াশীল। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা যুগ যুগ ধরে নিজেদের রাজনীতি বাদ দিয়ে বুর্জোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়েছেন। সাতচল্লিশে, একাত্তরে এবং নব্বইয়ে। বিপ্লব ছেড়ে দেওয়া ক্লান্ত বামপন্থীরা এদেশে বিএনপি আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছেন। বিভ্রান্তকর রাজনীতির কারণে ক্ষয়িষ্ণু হতে হতে বামপন্থী শক্তি এখন প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। তাদের প্রান্তিক অবস্থান যতটা না বেদনার, তার চেয়ে শতগুন কষ্টের কারণ হলো বিভ্রান্তিকর রাজনীতিতে তাদের আটকে থাকা, সেখান থেকে বের না হওয়া। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের অতিষ্ট জনগণ দীর্ঘদিন বামপন্থীদের দিকে তাকিয়েছিল। তারা জনগণকে হতাশ করেছে। সম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলনও এসব বামপন্থীদের আলোকিত করতে পারছে না।
বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা গেছে, হিন্দু মুসলমানের বৈরী সম্পর্ক যখনই স্থগিত হয়েছে, তখনই অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে উঠেছে। বিপরীতে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি মানুষকে বিভক্ত করেছে, কখনই মানুষকে এক করতে পারেনি।
ধর্ম ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে ষাটের দশকে ভাষা ভিত্তিক জাতীয় চেতনার উম্মেষ ঘটে, যা বিপুল প্রাণ শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল। সেই প্রাণশক্তির  আঘাতেই আইউবের শাসন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।
এর ফলে পূর্ববাঙলায় বাঙালির আত্মপরিচয়ের যে সংকট ছিল, একাত্তরে সেটা আপাত সুরাহা হয়েছিল, পুরোপুরি নয়। পরবর্তি শাসকরা সেই সুরাহা হওয়া অর্জন ধুলিস্যাৎ করেছে। পূর্ব বাংলায় ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এখানকার হিন্দু মুসলমানদের এক করেছিল, তাদের বৈরী সম্পর্ক স্থগিত করে দিয়েছিল। পূর্ব বাংলার ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা বহু দাম দিয়ে কেনা, মুক্তিযুদ্ধের অর্জন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা ধুলিস্যাৎ হতে থাকে শেখ মুজিবের হাত ধরে। তিনি ওই সময় ভারত ও রাশিয়ার অসম্ভব প্রভাব কাটাতে ইসলামী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার হাত ধরেই ইসলামীক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, ওআইসির সদস্য পদ গ্রহন ও ইজতেমা ভিত্তিক ইসলাম প্রচারণার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হয়। জিয়া এরশাদ সেই ধারাকেই ষোলো কলায় পরিপূর্ণ করেছেন মাত্র। দেশকে কে কতটা পাকিস্তানি ভাবাদর্শের কাছে দেশটা নিয়ে যাওয়া যায়, তারই প্রতিযোগিতা যেন শুরু হয়। শেখ হাসিনার কৃতিত্ব হলো, সরকারি টাকায় ৪৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, দারাওয়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া প্রভৃতি কাজ সত্ত্বেও সরকারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কাছে পাকা আসন বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। কিন্তু সরকারপন্থী ধর্মনিরপেক্ষতা আর সরকারপন্থী ধর্মচর্চার ভন্ডামী তরুণ প্রজন্ম ধরে ফেলেছে। তারা এসব আত্মপরিচয়ে সন্তষ্ট নয়।
আমরা জানি, গত তিন সাড়ে তিনশ বছরে পূর্ববাঙলার মানুষ আটবার রাজধানী পাল্টিয়েছে। রাষ্ট্রের সীমানা পাল্টিয়েছে কয়েকবার। মোঘল আমলে রাজধানী ছিল দিল্লী, নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার আমলে মুর্শিদাবাদ, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে কলিকাতা, শাসনদন্ড ব্রিটিশ সরকার গ্রহণ করলে, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনামলের শেষের দিকে ফের রাজধানী দিল্লীতে চলে যায়। এরপর পাকিস্তানী আমলে রাওয়াল পিন্ডি, করাচি ও ইসলামাবাদও রাজধানী ছিল। একাত্তরের পর প্রিয় ঢাকা ফিরে পায় রাজধানীর মর্যাদা।
মোঘল আমলের সুবা বাংলা, নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার সময় বাংলার অন্তর্ভুক্ত ছিল পূর্ববাংলা, পশ্চিমবাংলা, ঝাড়খণ্ড, আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আয়তন ছিল আরো বিস্তৃত, সেখানে উভয়বাংলা ছাড়াও আসাম, বিহার উড়িষ্যা এবং মধ্য প্রদেশ অন্তভুক্ত ছিল। বঙ্গভঙ্গের আগেও পূর্ববাংলার সঙ্গে ছিল পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা। আরাকানও এক সময় বাংলার অর্ন্তভুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা সংস্কৃতির নৈকট্য রয়েছে। নৈকট্য রয়েছে নৃতত্ত্বের। রাজনৈতিক নৈকট্য লাভের সম্ভবনা রয়েছে মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মেঘালয়, অরুনাচলের সঙ্গে। এসব এলাকার জনগণকে বিভক্ত করে রেখেছে ধর্ম ও রাষ্ট্র। আমাদের অসমাপ্ত আত্ম পরিচয়ের সন্ধান করতে গেলে এসব ইতিহাসের দিকে নজর ফেরাতে হবে। যে রাষ্ট্র মানুষকে বিভক্ত করে, সেই রাষ্ট্রের অধীনে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। যে রাষ্ট্র মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, তেমন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, ধর্ম মানুষ মানুষে বিভক্তি আনে। তাই ধর্মকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে সরাতে হবে, ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত চর্চার পর্যায়ে। রাষ্ট্রের কাছে ধর্ম থাকলেই সে শোষনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। উন্নত স্বপ্ন, তাকে মূর্ত করার কর্মসূচি ছাড়া শাসক বদলের কোনো মানে হয় না।
বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে পরিবর্তনের মুখে। শেখ হাসিনার বিদায় এখন সময়ের ব্যাপার। তাকে যেতেই হবে। অবশ্যই যেতে হবে। তা না হলে ইতিহাস মিথ্যা হয়ে যাবে। কোথায় যাবেন, ইতিহাসের নর্দমায়, বসবেন ইয়াহিয়ার পাশে। তার হাতে রক্তের দাগ। তিনি গণহত্যাকারী। শাসন করছেন মুক্তিযুদ্ধের নামে। আর শাসনের নামে চলছে অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, জনতার সম্পদ আত্মসাৎ, লুটপাট, অনিয়ম ও দুর্বৃত্তায়ন। এভাবে জেকে বসে আছে যে, হাসিনার সরকারকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ করা সম্ভব নয়। আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধই হাসিনার শাসনের মতাদর্শিক ভিত্তি। আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মাণ করলে, ওদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্যিক নৌকা মাঝ দরিয়ায় ডুববে। পাকিস্তান আন্দোলনের আইকন ছিলেন মোহাম্মাদ আলী জিন্না, অনুসারিরা তাকে কায়েদা আযম বলতেন। তাকে নাকচ করার পরই বাংলাদেশ আন্দোলনের পালে বাতাস পেয়েছিল। এবার কাকে নাকচ করতে হবে? এইটি কোটি টাকার প্রশ্ন।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!