ঢাকা, ১২ মার্চ: বাংলাদেশে নারীদের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শরিয়া প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা বিতর্কিত ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে, যা দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও চেতনার ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালানো হচ্ছে। নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত, নারীদের হয়রানি, তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত করার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। কিছু ইসলামী বক্তার বিতর্কিত বক্তব্যের মাধ্যমে উসকানি দেওয়া হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে।
নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করেছেন। স্মারকলিপি প্রদান করতে গেলে তারা পুলিশের বাধার সম্মুখীন হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শাহবাগ হয়ে পদযাত্রার সময় পুলিশ ব্যারিকেড দেয় এবং আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে ব্যারিকেড অতিক্রমের চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও জলকামান ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালায়। পুলিশের এহেন আচরণের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
বিশেষত, পুলিশের এসি মামুনের ভূমিকা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কেন তিনি পুলিশের পোশাক ছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং কেন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে দমননীতি প্রয়োগ করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার রাজনৈতিক সংযোগ ও কর্মকাণ্ড তদন্তের দাবি উঠেছে। পুলিশের এই ভূমিকা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সরকারি ভাষ্য মতে, ‘সঠিক’ ছবি প্রকাশিত হয়নি, যা পাল্টা বক্তব্য হিসেবে সামনে আনা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের নেতা লাকি আক্তার ধর্ষণবিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়ায় তাকে নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। লাকি আক্তারকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যা দিয়ে শাহবাগে তার গ্রেপ্তারের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। রাতের বেলা বের হওয়া মিছিলের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং তাদের স্লোগানেও রাজনৈতিক বিতর্কের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
লাকি আক্তার কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং অতীতে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কোটা বাতিলের আন্দোলনে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ২রা আগস্টের দ্রোহ যাত্রায় অংশ নিয়ে হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে মিছিলে ছিলেন। তাই তাকে শুধুমাত্র সরকারবিরোধী তকমা দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা অযৌক্তিক। ধর্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তার আছে এবং গণজাগরণ মঞ্চের অনেকেই একসময় হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে, সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে বামপন্থীদের এককভাবে কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তবে, নারীদের অধিকার, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার জন্য একীভূত আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশে নারী নিপীড়ন, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদী দমননীতি রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, যা গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল। কিন্তু আন্দোলনটি যথাযথভাবে সমন্বয় করতে না পারায় এটি এককভাবে সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। নতুন করে গণজাগরণ মঞ্চের স্লোগানকে সামনে রেখে আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনার সঙ্গে আওয়ামী রাজনীতির কোনো সংযোগ নেই। বরং, এই সম্ভাবনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান।
লাকি আক্তারকে ঘিরে মব সৃষ্টির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি। দুঃখজনকভাবে, অধিকাংশ মানুষ এ বিষয়ে নিরব রয়েছে, যেন কিছুই ঘটছে না। এ সুযোগে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে চাপে ফেলতে মাঠে নেমেছে, যা হতাশাজনক। সিপিবি এবং অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে সমালোচনা থাকতেই পারে, তবে লাকি আক্তার বা সিপিবির বিরুদ্ধে মৌলবাদী উত্থান দেখেও চুপ থাকা সংকীর্ণতা। আজ লাকি আক্তারকে টার্গেট করা হয়েছে, কাল হয়তো অন্য কেউ, পরশু আরেকজন—এভাবে মৌলবাদী মবের লক্ষ্য হয়ে উঠতে পারেন সমস্ত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিরা। দেশে নারী নিপীড়ন, বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদী দমননীতি রুখতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি।