বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:০৯ অপরাহ্ন

সামনে বাম, পিছনে ষড়যন্ত্র – যুগান্তরের বাম বিরোধী প্রচারণা নিয়ে আলাপ

যমুনা রহমান
সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

এক

দৈনিক যুগান্তর দেশের অন্যতম প্রথম সারির দৈনিক। বুধবার, ১৮ মার্চ ২০২৫-এ “সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র সামনে বাম, পিছনে আওয়ামী লীগ” শিরোনামে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন রেখে “বিশেষ প্রতিনিধি” নামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনের মূল বক্তব্য, ভারত ও আওয়ামী লীগের মদদে বামপন্থীরা দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সক্রিয়। তারা শাহবাগ ও শহীদ মিনার থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়েও যুগান্তরের রিপোর্টটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। বিশেষ প্রতিনিধি নামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটির মাধ্যমে সাংবাদিকের নিরাপত্তার বিষয়টিকে কেউ যুক্তিসঙ্গত বলতে পারেন। তবে প্রতিবেদনে সিপিবি ও গণফোরামের নেতাদের বক্তব্য থাকায় সাংবাদিকের পরিচয় গোপন রাখার যৌক্তিকতা দুর্বল হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বামপন্থীরা সাংবাদিকদের ওপর কখনোই হামলা করেনি। প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট তথ্য না দিয়ে সরকারি ও সরকারপন্থীদের বক্তব্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সাংবাদিকের উদ্দেশ্যমূলক অবস্থানের পরিচায়ক।

যুগান্তরের পুরো প্রতিবেদনে নির্দিষ্ট তথ্যসূত্রের অভাব স্পষ্ট। প্রতিবেদক বারবার “সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র”, “বিশ্লেষকদের মতে”, “অভিযোগ রয়েছে”, “রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন”, “গোয়েন্দা সূত্র”-এর মতো অস্পষ্ট এবং অনির্দিষ্ট তথ্যসূত্রের উল্লেখ করেছেন। এতে প্রতিবেদনের বস্তুনিষ্ঠতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। প্রতিবেদকের বামপন্থী সম্পর্কে ধারণার অভাবও লক্ষ্যণীয়। তিনি সকলকে একত্রে বামপন্থী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। গণফোরামের নেতা সুব্রত চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে বামপন্থী হিসেবে, অথচ গণফোরাম নিজেদের কখনো বামপন্থী দাবি করেনি। গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন বরাবরই সমাজতন্ত্র-বিরোধী অবস্থানে ছিলেন। এমন একটি দলকে বামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা প্রতিবেদকের অজ্ঞতা ও পক্ষপাতিত্বকেই প্রকাশ করে।

দুই

যুগান্তরের ১৯ মার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “নেপথ্যে কলকাঠি নাড়াচ্ছে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী রাষ্ট্র।” প্রতিবেদক ভারতের নাম সরাসরি উল্লেখ করার সাহস পাননি। ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অযথা ভারত-বিরোধিতা একটি প্রচলিত রাজনৈতিক কৌশল। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবকিছুকেই ভারতের ষড়যন্ত্র বলে প্রচারের পুরোনো প্রবণতা রয়েছে। প্রমাণ ছাড়া যেকোনো প্রতিবাদকে ভারতের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ। বাস্তবে, বামপন্থীরা বরাবরই ভারতের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয়। মোদীর সফরবিরোধী আন্দোলনে তাদের অবস্থান এর স্পষ্ট প্রমাণ। হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনের সুযোগে বামপন্থীদের ওপর হামলা হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল সিপিবি। সিপিবি তাদের বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে হামলার প্রধান শিকার হয়েছে। বর্তমানে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকে ভারত ও আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বামপন্থীদের নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। অতীতে সিপিবি ও উদীচীর সমাবেশেও হামলা হয়েছে, যার পেছনে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির হাত রয়েছে। বামপন্থীরা আওয়ামী লীগকে কখনোই পুনর্বাসন করেনি। বরং বিএনপি ও জামায়াতসহ দক্ষিণপন্থীরাই স্বার্থের জন্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপস করেছে। শ্রমিক অধিকার, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, নারী ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দাবির আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করাই মূল ষড়যন্ত্র।

তিন

কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার প্রস্থানের পর থেকে সেই ঐক্য ভাঙার কাজ শুরু হয়। এই সময়ে স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন ভাঙচুর ও সাম্প্রদায়িক হামলার মাধ্যমে বিভাজন তৈরি হয়েছে। এই বিভাজনে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীরব ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগ রয়েছে, এই সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের স্বার্থে কাজ করেছে। ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা সক্রিয় হলে তাদের বিরুদ্ধেও হামলা শুরু হয়। প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে। বিশেষ করে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এসেছে, যা প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের লক্ষণ। ঐক্য বিনষ্টকারী মূল শক্তি হলো তারা, যারা সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিবেশ সৃষ্টি করছে। যুগান্তরের প্রতিবেদন এই তৎপরতারই একটি অংশ। যুগান্তরের প্রতিবেদনে উপসংহার বলা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা এবং ইনকিলাব মঞ্চ এই কথিত ষড়যন্ত্র ধরতে পেরেছে। নিপীড়ন, মিথ্যা সাংবাদিকতা, আন্দোলনকারীদের ষড়যন্ত্রকারী বানানো এবং বিভক্তি তৈরির মধ্যে দিয়েই আওয়ামী লীগ আমলের প্রতিচ্ছবি দেখতে  পাওয়া যায়।

 

 


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!