১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক বিভীষিকাময় কালরাত। এই রাতেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত গণহত্যা অভিযান শুরু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই অভিযানের পরিকল্পনা তৈরি করেন পাকিস্তানি দুই সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। কোনো লিখিত নির্দেশনা না রেখে মুখে মুখেই নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট কমান্ডারদের কাছে।
মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন তার লেখায় উল্লেখ করেন, শুধু ঢাকাতেই সেই রাতে সাত হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা এবং আরও তিন হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর পুরো পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত শ্বেতপত্রেও উল্লেখ করা হয়েছে, ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে এক লাখের বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল। সেদিন দুপুরের পর থেকেই ঢাকা ও সারাদেশে উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছিল। সেনা কর্মকর্তাদের ব্যস্ততা ছিল লক্ষণীয়। রাতে পিলখানা ইপিআর সদরদপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেতসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। ট্যাংক, মর্টার ও ভারী অস্ত্রের আক্রমণে পুরো ঢাকা শহর পরিণত হয় মৃত্যুপূরীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলসহ শিক্ষকদের বাসভবনে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন শিক্ষক নিহত হন। সেনা অভিযানের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্ণ বিজয় অর্জন করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১ মার্চ থেকে শুরু হয় নতুন আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন। এ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে পাকিস্তানের হাত ছাড়া হয়ে যায় তার পূর্বাঞ্চল ‘পূর্ব পাকিস্তান’। ওইদিনই পল্টনে এক স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার দাবি ওঠে।
- ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওড়ে সবুজের মাঝে লাল বৃত্তে বাংলাদেশের মানচিত খচিত নতুন পতাকা।
- ৩ মার্চ পল্টনে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় পাঠ করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার।
- ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবার সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনগণ এটাকেই স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সারাদেশে শুরু হয় মহড়া-প্রশিক্ষণ।
- ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস। সেদিন সারাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানানো হয়। শেখ মুজিবের বাসভবন সহ সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, বিভিন্ন বাসভবনে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। এমনকি বিভিন্ন দূতাবাসেও উড়তে দেখা যায় এ পতাকা। চিনা দূতাবাসে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ালেও জনতা তা জোর করে নামিয়ে দেয়।
- শুধু মাত্র কয়েকটি সেনানিবাস, সেনা ক্যাম্প এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে টিকে থাকে পুরনো দিনের পাকিস্তানের পতাকা। এভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে নিখোঁজ হয়ে যায় পাকিস্তানের অস্তিত্ব। কিন্তু তখনো দ্বিধা-দ্বন্ধ ছিল। ‘পূর্ব বাংলা’ কি পাকিস্তানের অংশ না-কি স্বাধীন বাংলাদেশ। কারণ, ২৩ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে গনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি মেনে নেন। অপেক্ষা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে ঘোষণার। কিন্তু ২৫ মার্চ লে. জে. পীরজাদার পক্ষ থেকে কোনও ডাক আসে না।
- সকল দ্বিধা-দ্ব›েদ্বর অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যা থেকেই ‘পূর্ব পাকিস্তান’এর বিভিন্ন সেনানিবাস ও সেনা ক্যাম্প থেকে বেড়িয়ে আসে পাকিস্তানি সৈন্যরা, উদ্দেশ্যÑ পাকিস্তান রক্ষার পরিকল্পনা ‘অপারেশ সার্চ লাইট’ বাস্তবায়ন করা।
- কী ছিল এই ‘অপারেশ সার্চ লাইট’-এ? অপারেশন সার্চ লাইটে বলা হয়, বাঙালিকে ভয় দেখাতে হবে। এমন ভয় দেখাতে হবে যাতে আর কোনও দিনই ‘স্বাধীকার’ আন্দোলন করার সাহস না পায়। নেতৃস্থানীয়দের আটক প্রয়োজনে হত্যা করে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে স্বাধীনতার স্বপ্ন ধূলোয় মিশিয়ে দিতে হবে। কার্ফূ দিয়ে জনগণকে দেখা মাত্র গুলি করতে হবে যাতে আর কোনও দিন ‘চোখে চোখ রেখে’ কথা বলার সাহস না পায়। অবশ্য অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা করা হয়ে ২৫ মার্চের বেশ কয়েকদিন আগে ১৮ মার্চে। সারাদেশের সড়কপথ স্বাধীনতাকামী জনগণের দখলে থাকায় বিভিন্ন সেনানিবাসে সে নির্দেশ ২৪ মার্চ দিনের বেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় হেলিকপ্টারে করে। পরদিন বিকেলে বিভিন্ন সেনানিবাসে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর আদেশ জারি করা হয় অয়্যারলেসে। তারপরেই করাচীর উদ্দেশ্যে উড়াল দেন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকে বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা। উদ্দেশ্য আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দিয়ে পুরো ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।
- সন্ধ্যায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা। উদ্দ্যেশ্য সশস্ত্র বাঙালি সদস্যদের নিয়ন্ত্রনে আনা, এজন্য ঢাকার পুলিশের সদর দফতর, হাজারীবাগ ইপিআর হেডকোয়ার্টার দখল করা এবং ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গুড়িয়ে দেওয়া। সেই সঙ্গে পথে পথে থাকা বাড়িঘর গুড়িয়ে দেওয়া, পুড়িয়ে দেওয়া, যাকে যেখানে দেখা যায় সেখানেই গুলি করে হত্যা করে লাশ রাস্তাঘাটে ফেলে রেখে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে কোনও বাঙালি আর ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস না পায়। শুধু ঢাকা শহরেই সেদিন লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়, পুড়িয়ে দেওয়া হয় তিরিশ সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি। ব্যপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নিয়ন্ত্রনে নেওয়া হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, হাজারীবাগ ইপিআর হেডকোয়ার্টার। ২৬ ও ২৭ মার্চ কার্ফু রেখে পাখির মতো দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করা হতে থাকে সাধারণ মানুষকে। ব্যাপক গণহত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ করে চট্রগ্রাম খুলনাকেও একই ভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
- জেলা ও মহুকুমা সদরগুলোকে নিয়ন্ত্রনে নিতে বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে পাঠানো হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের। প্রথম প্রথম কিছু নেতাকর্মীকে আটক, জনগণের ওপর গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের চেষ্টা করে। পরে বাঙালি পুলিশ ইপিআরের সহযোগিতায় নিরস্ত্র জনগণর প্রতিরোধের মুখে জেলা শহর থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। মুক্ত হয় পাবনা কুষ্টিয়া, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কুমিল্লাসহ জেলা শহরগুলো। এছাড়া ৪৫ মহুকুমা শহরে পাকিস্তানি সৈন্য পাঠাতে না পারায় তারা স্বাধীন ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল ১ মার্চ পরবর্তী সময় থেকেই। এ ভাবেই ব্যার্থ হয় অপারেশন সার্চ লাইট। পরে পাকিস্তান থেকে অন্তত দুই ডিভিশন সেন্য আনতে হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পূণরুদ্ধারে। তাই ২৫ মার্চ শুধু মাত্র ‘কালোরাত্রি’ বা ‘গণহত্যা’ দিবস নয়, ২৫ মার্চ সকল দ্বিধা-দ্ব›দ্ব, দোদুল্যমানতা ঝেড়ে ফেলে ঘুরে দাঁড়ানোর দিবস, ‘স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’ এমন বজ্রকঠিন শপথ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দিবসও।