ক্রিসমাস, বসন্ত উৎসব, দীপাবলি, ঈদুল আযহা, ইস্টার, ইয়োম কিপুর, বুদ্ধ পূর্ণিমা, হানুক্কা, রমজান—বছরজুড়ে অসংখ্য ধর্মীয় উৎসব পালিত হয়। বিশ্বে প্রায় ৭১০ কোটি মানুষের মধ্যে ৩১ শতাংশ খ্রিষ্টান, ২৩ শতাংশ মুসলমান, ১৩ শতাংশ হিন্দু এবং প্রায় ৭ শতাংশ বৌদ্ধ। এছাড়া লাখ লাখ মানুষ ইহুদি, জৈন এবং স্পিরিটিজমের মতো ধর্ম পালন করেন। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় ২ শতাংশ বা প্রায় ১৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ঈশ্বর বা দেবতায় বিশ্বাস করেন না। তাদের জন্য উৎসব নেই কেন—এই প্রশ্ন থেকেই উদ্ভব হয়েছে ‘নাস্তিক দিবস’-এর।
২০০৩ সালে ইন্টারনেটে একটি মজার গল্প প্রকাশিত হয়, যেখানে এক কাল্পনিক নাস্তিক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন এই অভিযোগে যে তাঁর মতো ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো উৎসব নেই। বিচারক মজা করে ১ এপ্রিলকে (এপ্রিল ফুল দিবস) নাস্তিকদের দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। যদিও এটি নিছকই হাস্যরস ছিল, পরবর্তীতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব নাস্তিক দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
‘নাস্তিকতা’ শব্দটির উৎপত্তি প্রায় ৪০০ বছর আগে, মধ্যযুগের ইউরোপে হলেও ধারণাটি ধর্মের মতোই প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ সালে ইহুদি ধর্মে নাস্তিকতার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরবর্তীতে খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামের মধ্যেও নাস্তিকতার অস্তিত্ব ছিল। ভারতে খ্রিষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ‘লোকায়ত’ দর্শন সরাসরি নাস্তিকতাকে সমর্থন করত। তবে প্রাচীন সময়ে নাস্তিকতা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না, বরং নাস্তিকদের সমাজচ্যুত করা, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হতো।
মধ্যযুগে পারস্যের আল-মাআরি এবং জার্মানির নিকোলাস অব কুসার মতো মুক্তচিন্তকরা নাস্তিকতার প্রসারে ভূমিকা রাখেন। রেনেসাঁ যুগে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও নিকোলো মেকিয়াভেলি চার্চের প্রচলিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করেন।
কমিউনিজমের প্রসারের ফলে পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ায় নাস্তিকতার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে ‘নাস্তিক’ শব্দটি শুধু ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এর মধ্যে নানা স্তর দেখা যায়। কেউ ঈশ্বরের ধারণাকে সন্দেহ করেন, কেউ বিশ্বাস করেন না কিন্তু সহ্য করেন, আবার কেউ সরাসরি বিরোধিতাও করেন। এখান থেকেই ‘অজ্ঞেয়বাদ’ বা Agnosticism-এর সৃষ্টি, যা ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব কোনোটাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণযোগ্য নয় বলে মনে করে।
নাস্তিক দিবস উদযাপনের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। তবে মানুষ সাধারণত এদিন তাদের অবিশ্বাস প্রকাশ করেন বা ধর্ম নিয়ে আলোচনার আয়োজন করেন। এদিন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীরা পরস্পরের সঙ্গে গভীর আলোচনায় নিজেদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি সমৃদ্ধ করতে পারেন। এটি ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ নয়, বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার সংস্কৃতি বিকশিত করতে সাহায্য করে।
ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিক্যাল ইউনিয়ন (আইএইচইইউ)-এর গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৮৫টি দেশে নাস্তিকরা প্রচণ্ড বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ধর্ম বা ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক ৩০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।