বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৩ অপরাহ্ন

এপ্রিল ফুল – April Fools Day এবং ইসলামিক প্রোপাগান্ডা

অপু সারোয়ার
সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। যদিও এই দিনে কোনো দেশেই সরকারি ছুটি বা আনুষ্ঠানিক সরকারি উদযাপন নেই। খ্রিস্টান বা ইহুদি ধর্মেও এপ্রিল ফুলকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদযাপন করা হয় না। এপ্রিল ফুলের সব আয়োজনই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। সাধারণত এই দিনে একে অপরকে চমকে দিয়ে ‘বোকা বানানোর’ চেষ্টা করা হয়। পরিবারের ছোটরা বড়দের সঙ্গে এবং বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীরা একে অপরের সঙ্গে বিভিন্নভাবে মজা করে। দিনশেষে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে সবাই একসাথে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় ‘এপ্রিল ফুল!’

মুসলিম বিশ্বে এপ্রিল ফুল দিবস নিয়ে নানা ধরনের প্রোপাগান্ডা প্রচলিত রয়েছে। অনেকেই প্রচার করেন যে, এটি ইসলাম বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি দিন। বিশেষত বাংলাদেশে এপ্রিল ফুল পালনের চেয়ে বরং এর বিরুদ্ধে প্রচারণা বেশি দেখা যায়। প্রচারণার মূল কারণ হিসেবে দেখানো হয় ‘ইসলামি মূল্যবোধ’। বাংলাদেশের একটি প্রচলিত ধারণা হলো, এপ্রিল ফুলের সঙ্গে মুসলমানদের বোকা বানানোর ইতিহাস জড়িত।

মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত একটি মিথ অনুযায়ী, স্পেনে ১৫ শতকের শেষ দিকে মুসলিম শাসনের পতনের পর রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা মুসলমানদের একটি মসজিদে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিলেন, যা নাকি ১লা এপ্রিল ঘটেছিল। তবে ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, স্পেনে গ্রানাডার পতন আসলে ১৪৯২ সালের ১ বা ২ জানুয়ারিতে ঘটেছিল। ঐতিহাসিক ফিরাস আল-খাতিব তার “Lost Islamic History” গ্রন্থে ১ জানুয়ারি ১৪৯২ তারিখ উল্লেখ করেছেন, আবার জোসেফ এফ. ও’ক্যালাঘানের “A History of Medieval Europe” গ্রন্থে এই তারিখটি ২ জানুয়ারি হিসেবে পাওয়া যায়। সুতরাং এপ্রিল ফুলের সঙ্গে মুসলিম নিপীড়নের এই গল্প ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নয় এবং এটি একটি ভিত্তিহীন মিথ মাত্র। প্রায় ৮০০ বছর ধরে স্পেন আরব সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, যার সমাপ্তি ঘটে ১৪৯২ সালে। অন্য দেশের ভূমি দখল করা বা ঔপনিবেশিক আগ্রাসন, যেমন মুহাম্মদ ঘোরীর ভারত দখল বা ব্রিটিশদের ভারত দখল—সবই ইতিহাসে আগ্রাসন ও ভূমি দস্যুতার উদাহরণ। মুসলমানরা স্পেন ‘হারিয়েছে’ বলা যেমন ভুল, তেমনি ব্রিটিশরাও তাদের উপনিবেশগুলো ‘হারিয়েছে’ বলে দাবি করে না। দখলকৃত ভূমি হাতছাড়া হওয়াকে ‘হারানো’ বলা যায় না।

এপ্রিল ফুল দিবস পালনের প্রকৃত ইতিহাস আজও অস্পষ্ট। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারণা হলো, ১৫৮২ সালে ফ্রান্স জুলিয়ান থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে স্থানান্তরের সময় এপ্রিল মাসের প্রথম দিনে নববর্ষ পালনকারীদের নিয়ে ঠাট্টা শুরু হয়। সেই সময় নববর্ষের দিনটি জানুয়ারিতে স্থানান্তরের খবর দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ায় যারা পুরনো রীতিতে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে নববর্ষ পালন করতেন, তাদের ‘এপ্রিল ফুল’ বলে বিদ্রূপ করা হতো। প্রাচীন রোমের ‘হিলারিয়া’ উৎসবের সঙ্গেও এপ্রিল ফুল দিবসের মিল রয়েছে। এই উৎসবে রোমানরা ছদ্মবেশ ধারণ করে নাগরিক ও বিচারকদের বিদ্রূপ করত। আবার বসন্তের শুরুর দিনটিও এপ্রিল ফুলের উৎস হতে পারে, যখন আবহাওয়ার পরিবর্তনে মানুষ বিভ্রান্ত বা “বোকা” হয়ে যেত।

১৮ শতকের ব্রিটেনে এপ্রিল ফুল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। স্কটল্যান্ডে দুই দিনব্যাপী এই দিবসটি পালিত হতো। প্রথম দিন “হান্টিং দ্য গক” বা কোকিল ধরা এবং দ্বিতীয় দিন “টেইলি ডে” বা লোকদের পেছনে কাগজের নকল লেজ লাগিয়ে মজা করা হতো। আধুনিক যুগে এপ্রিল ফুলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম উদ্ভাবনী ও মজার প্রাঙ্ক করেছে। যেমন ১৯৫৭ সালে বিবিসি সুইজারল্যান্ডে স্প্যাগেটি গাছে উৎপাদিত হচ্ছে বলে ভুয়া সংবাদ প্রচার করে। ১৯৮৫ সালে “স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড” কাল্পনিক খেলোয়াড় সিড ফিঞ্চের সংবাদ প্রকাশ করে। ১৯৯২ সালে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (NPR) সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফের প্রার্থিতার মিথ্যা খবর দেয়। এছাড়া ১৯৯৬ সালে ট্যাকো বেল ও ১৯৯৮ সালে বার্গার কিং তাদের অভিনব প্রাঙ্কের মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। গুগল প্রতিবছর এপ্রিল ফুল দিবসে বিশেষ প্রাঙ্ক করে থাকে, যেমন ‘টেলিপ্যাথিক সার্চ’ বা ম্যাপে ‘প্যাকম্যান’ গেম চালু করা। এপ্রিল ফুল দিবস একটি নির্দোষ ও আনন্দপূর্ণ দিবস, যা ইতিহাসের নানা ভুল প্রচারণা থেকে পৃথক এবং এর মূল উদ্দেশ্য নিছক মজা ও বিনোদন।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!