বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪ অপরাহ্ন

‘গণতন্ত্র ও অধিকার’ হুমকির মুখে: গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি

সমসমাজ ডেস্ক
রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও আইনের শাসন ব্যাহত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। শনিবার রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম মিলনায়তনে আয়োজিত সভায় এই মূল্যায়ন তুলে ধরা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। কমিটির সদস্যদের ভাষ্য, মব ভায়োলেন্স, শিক্ষার্থীদের ওপর দমন, কৃষক ও শ্রমিকের প্রতি বৈরী আচরণ, বিচারব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব এবং দ্রব্যমূল্য অস্থিরতা এখনো বিদ্যমান।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “সংস্কারের অনেক কাজ এই সরকারই করতে পারে, কিন্তু করছে না। বসুন্ধরার মতো গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।” বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারী অধিকার, পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ও শ্রমিকদের সংকট নিয়েও বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা। তারা সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার প্রস্তাবেরও সমালোচনা করেন। সভায় অভিযোগ করা হয়, ক্যাম্পাসে পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতা, নারী নির্যাতন, হরিজন ও পাহাড়িদের প্রতি বৈষম্য, শ্রমিক ছাঁটাই এবং স্বাস্থ্যখাতে অব্যবস্থাপনা অব্যাহত রয়েছে। কমিটির মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না হয়ে বরং পুরোনো দমনমূলক ধারা বজায় রয়েছে। অবিলম্বে মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপহীন সংস্কার বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সত্যটা হচ্ছে আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে ফ্যাসিবাদ হয়েছে, সেটা ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্য দিয়ে হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে প্রতারণা করার কারণে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতারণা করে, ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, ধর্মীয় নিপীড়নকে নানাভাবে নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করার চেষ্টা করে, মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করে এবং জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিল আওয়ামী লীগ। সংবিধানের মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়া-সংক্রান্ত প্রস্তাবেরও সমালোচনা করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশন যেভাবে বলছে সমাজতন্ত্র হচ্ছে গণতন্ত্রবিরোধী ব্যবস্থা, তারা তো নিশ্চয়ই জানে যে পুঁজিবাদের যেমন অনেক রকম মডেল আছে, সমাজতন্ত্রেরও বিভিন্ন ধরন আছে।…তার চেয়ে পরিষ্কার করে বলুক সমাজতন্ত্র বাদ দিয়ে পুঁজিবাদ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আপনারা সংবিধানের সংস্কার করার কথা বলে এই মাধ্যম যদি আপনারা গ্রহণ করেন, তাহলে বৈষম্যহীনতার দিকে যাওয়ার পরিবর্তে বৈষম্য বৃদ্ধির দিকে যাওয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তিটা তৈরি করছেন। সেটা তাহলে কোথায় সংস্কার, কোথায় পরিবর্তন?’

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, উত্তরাধিকার প্রশ্ন কিংবা নারীর অধিকার প্রশ্ন এলেই বাংলাদেশের বৈষম্যবাদী রাজনীতি বা মতাদর্শ যারা ধারণ করে, ধর্মের নামে হোক জাতির নামে হোক, তাদের মধ্যে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়। কারণ, ধর্ম পালন করুক বা না করুক, নারী প্রশ্ন এলেই ধর্মের অজুহাত দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আবার সেটা নিয়ে একটা উন্মাদনা ও সহিংসতা তৈরি করার চেষ্টা চলে। কিছু লোক ধর্মের নাম করে হত্যার কথা বলছে। তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশের কঠোর সমালোচনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিলে বহুত্ববাদ কী করে হয়? কারণ, ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই হচ্ছে যে রাষ্ট্র সব ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে। কোনো ধর্মের ব্যাপারে পক্ষপাত থাকলে বহুত্ববাদ কী করে হবে?’

সভায় হরিজন জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে সভায় বক্তব্য দেন নারী নেত্রী সীমা দত্ত। জুলাই আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা নিয়ে বক্তব্য দেন স্থপতি আরিফুল হক। সমবায়ের প্রতারণার চিত্র নিয়ে বক্তব্য দেন গণমুক্তি ইউনিয়নের আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন আহমেদ। গত আট মাসে ‘মব’–এর কারণে নারীরা সবচেয়ে বেশি হেনস্তার শিকার হয়েছেন—এমন মন্তব্য করেন মানবাধিকারকর্মী ফেরদৌস আরা রুমী। ‘নারী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী’ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ নিয়ে মাঠ গরম করা হচ্ছে। এই কমিশনের সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।

পাহাড় ও সমতলের জাতিগোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হেমা চাকমা। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরও দেশ বৈষম্যমুক্ত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীন চলাচলে বিধিনিষেধ, কোথাও কোথাও পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে এই শিক্ষার্থী প্রশ্ন রাখেন, দ্বিতীয় মুক্তি বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা শুধু সমতলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না।শিল্প ও শ্রমিকের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকেরা ন্যায্য দাবিদাওয়া তুলে ধরলে ছাঁটাই করা হচ্ছে। এই ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে শ্রমিকদের মধ্যে এখন একধরনের ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছে।

[ ২০২৪ অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিরোধী যে কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি’। ]


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!