বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪ অপরাহ্ন

ধর্ম অবমাননার লালমনিরহাট স্টাইল ও একজন পিতা -পুত্রের কাহিনী

সমসমাজ ডেস্ক
শনিবার, ২৮ জুন, ২০২৫

দেশে ক্রমাগত হিন্দু নিপীড়ন চলছে। এর বিরুদ্ধে মুক্তমনা বা প্রগতিশীলদের তেমন কোন মাথা ব্যাথা নেই। অনেকেই এই সব নিপীড়নকে বৃহত্তর নিপীড়ণের অংশ হিসাবে দেখে থাকেন। বাংলাদেশে কোন সাম্প্রদায়িক কোন সমস্যা নেই। এমন বার্তা দেওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অসাম্প্রদায়িক দাবিদারদের লক্ষ্য। কোন হিন্দু বা সংখ্যালঘু আক্রমণের শিকার হওয়াকে রাজনৈতিক হানাহানি অংশ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা মুসলিম পরিবার থেকে উঠে আসা জনগোষ্ঠীর ডান -বাম ও মধ্যপন্থীদের আকাঙ্খা। দেশে সাম্প্রদায়িকতা না ধর্মের রাজনৈতিক ব্যাবহার হচ্ছে এই নিয়ে বিতর্ক চলমান। ৫ অগাস্ট ২০২৪ সালে হাসিনার পলায়নের পর হিন্দু এবং মুসলিম সমাজের প্রান্তিক অংশ আহমেদিয়া মুসলিম ও পীর পন্থীদের উপর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।
পরেশ চন্দ্র শীল ও বিষ্ণু চন্দ্র শীল লালমনিরহাটের সদর থানার গোশলা বাজার এলাকার নাপিত। এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে পিতা ও পুত্র । অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষ। দুজনে দীর্ঘদিন ধরেই একটি চুল কাটার দোকান /সেলুন পরিচালনা করে আসছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে মব সৃষ্টি করে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়। যে দুজনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ, তারা সকল অর্থেই প্রান্তিক মানুষ। ৭০ বছরের যে মানুষকে হেনস্তা করা হয়েছে , তিনি একটি হাতা ছাড়া গেঞ্জি পড়ে কাজ করছিলেন। এই ছবিটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সচরাচর এই ধরণের গেঞ্জি শার্টের নিচে পরে থাকে। নির্যাতিতের পোশাক দেখে অর্থনৈতিক অবস্থান সহজেই অনুমান করা সম্ভব।
রবিবার , ২২ জুন দুপুরে লালমনিরহাট শহরের হানিফ পাগলার মোড়ে পরেশ চন্দ্র শীল ও তাঁর ছেলে বিষ্ণু চন্দ্র শীলের দোকানে গিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে তাঁদের মারধর করেন উগ্রবাদী মুসলিমরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একদল লোক বাবা-ছেলেকে মারধর করছেন। এরপর সদর থানার একদল পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। ঘটনার পরে কয়েক শ মুসলিম থানা চত্বরে এসে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় উত্তেজিত জনতার সামনে বক্তব্য দেন সদর থানার ওসি নুরনবী। ওসির বক্তব্যের একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে ওসিকে বলতে শোনা যায়, ‘ওসি হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমার। কিন্তু যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমারও কলিজায় আগুন লেগেছে। আপনাদের মতো চোখে পানি আমারও এসেছে। কীভাবে এত বড় ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এ দেশে করে। আমি আপনাদের ওয়াদা দিলাম। আমি তাদের যখন অ্যারেস্ট করেছি। বাংলাদেশে এমন মামলা তাদের দেব, নিশ্চিত তাদের যেন যাবজ্জীবন বা ফাঁসি হয়…।’ সদর থানার ওসি নুরনবীর বক্তব্যের পর ন্যূনতম ন্যায় বিচারের আশা করা একটি দুঃস্বপ্ন।
পরেশ চন্দ্র শীলরা দীর্ঘ দিন একই দোকান চালিয়ে আসছে। শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এই চুল কাটার জন্য আসে। পাশের দোকানদাররা সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছে অতীতে কখনো এই জাতীয় অভিযোগ শোনেননি। শীলদের পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে শুক্রবার , ২০ জুন এক জন চুল কাটার খরিদ্দারের সাথে ১০ টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি পর শীলদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। রবিবারে এই হেনস্তা হয়। বিষ্ণু চন্দ্র শীলের স্ত্রীর বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অধিকাংশ গণমাধ্যম এই ব্যাপারে দায়সাড়া গোছের বক্তব্য ছাপিয়েছে। এই দায়সাড়া গোছের বক্তব্যের পিছনে রয়েছে প্রধানতঃ পরমত অসহিষ্ণুতা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক ভাবে ধর্মীয় আবহ। স্কুল কলেজে পাঠ্য পুস্তক সেখানেও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা শিক্ষার চর্চা হয়। হাসিনার আমলে মুসলিম উগ্রবাদীদের তোষণের নামে বিভিন্ন সময় অতি মামুলি গল্প কবিতা পাঠ্য পুস্তক থেকে বাদ দেওয়ার আলোচিত নজির রয়েছে। ইউনুস সরকারের আমলেও পাঠ্য পুস্তকে আদিবাসী শব্দ থাকা নিয়ে মুসলিম উগ্রবাদীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং সমতল পাহাড়ি ছাত্রদের উপর আক্রমনের সংবাদ গণমাধ্যমে মধ্য জানুয়ারি ২০২৫ সালে এসেছে।
পরেশ চন্দ্র শীলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ইসলামের নবী মোহাম্মদকে কেন (সাঃ) বলেন নাই। (সাঃ) এর অর্থ সালাম দেওয়া। একজন অন্য ধর্মের মানুষের সালাম দেওয়া না দেওয়ার সাথে কি একজন ধর্ম প্রবর্তকের সন্মান নির্ভর করে ? সম্মানের বিষয়টি কি এতই ঠুনকো ? অন্য ধর্মের মানুষকে কেন (সাঃ) বলতে হবে বা বলতে বাধ্য করা হবে। শ্রী কৃষ্ণ হিন্দুদের দেবতা। হিন্দুরা শ্রী কৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান মনে করেন। যদি কোনো ব্যক্তি শ্রী কৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান মনে না করেন তা হলে হিন্দুদের কোনো সমস্যা হয় না। মুসলিম বা ক্রিস্টানদের জানার কথা নয় যে হিন্দুরা শ্রী কৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান মনে করেন। এটাই স্বাভাবিক। ইসলামের নবীর বিষয়টি এমনটি হতে না পাড়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। পরেশ চন্দ্র শীল পিতা -পুত্রের গ্রেফতারের পর আব্দুল আজিজ থানায় অভিযোগ পত্র জমা দিয়েছেন। আব্দুল আজিজ পেশায় মসজিদের ইমাম। আব্দুল আজিজের লিখিত বক্তব্যের ফাঁক – ফোকড় অনেক। আব্দুল আজিজ লিখিত অভিযোগের অনুরুপ ভিডিও বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েক মাস ধরেই পরেশ চন্দ্র শীলরা ধর্ম অবমাননা করে আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এত দিন তিনি বা অন্য মুসলিমরা কেন নিরব ছিলেন ? আব্দুল আজিজের দাবি পরেশ চন্দ্র শীল দাড়ি কাটার কথা বলছেন। চুল – দাড়ি কাটা শীলদের ব্যবসা। এই জন্য একটি দোকান খুলে বসেছেন। চুল কাটার জন্য বসার শুরুতে নাপিত জিজ্ঞাসা করে চুল ছোট রাখবেন না বড় করে রাখবেন। দাঁড়ি কি সাইজ করবেন , ফেলে দিব,নাকি রেখে দিব। এই প্রশ্ন গুলো দিয়েই চুল কাটার ব্যবসা চলে। হিন্দু – মুসলিম নির্বিশেষে চুল-দাড়ি কাটার পেশার সাথে জড়িতদের সকলে একই প্রশ্ন করে থাকেন। যদি পরেশ চন্দ্র শীল এই জাতীয় কোন কথা বলে থাকেন তবে পেশার বাইরে নতুন কোন প্রশ্ন করেননি। আব্দুল আজিজের অভিযোগে এসেছে পরেশ চন্দ্র শীল ইসলামের নবীর অন্যতম স্ত্রী আয়শার বিয়ের বয়স নিয়ে কথা বলছেন। আয়শার বিয়ের বয়স কোন গোপন বিষয় নয়। ইসলামী বই পুস্তকে বিষয়টির উল্ল্যেখ রয়েছে। এই বিষয়টি কেউ কখনো লুকানোর চেষ্টা করেছে এমন শোনা যায় না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই সব অভিযোগের কোন নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য সাক্ষী নেই। যারা আক্রমণ করেছেন তাদের মধ্যে থেকে দুইজনকে সাক্ষী করেছেন অভিযোগকারী আব্দুল আজিজ।
৯০% মুসলমানের দেশে ২০ জন মিলে একটা অভিযোগ দিলে মামলা হয়। তবে অভিযোগ কোন প্রমাণিত বিষয় নয়। আর থানায় নিয়ে পিটানো কিংবা ভয় দেখালে অধিকাংশই অপরাধ না করে অপরাধ স্বীকার করে নেয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। বাংলাদেশে থেকে কোনো সাধারণ হিন্দু মাস দুই মাস ধরে ইসলাম অবমাননা করে যাবে,আর বাংলাদেশের মুসলমানরা শুনে যাবে। এমন পরিবেশ ১৯৪৭ সালের পরে কখনো ছিল না। ধর্ম অবমাননা নামের ক্যান্সারের অজুহাতে হিন্দু ও মুক্ত চিন্তার মানুষরা নির্যাতিত হচ্ছে আওয়ামীলীগ আমল থেকেই। এর আগেও বিষয়টি ছিল তবে হাসিনার পৃষ্টপোষকতায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে । একই নাটক,গুজব ছড়িয়ে বলবে নবী মোহাম্মদ কে অবমাননা করেছে। কিন্তু কোনো প্রমান নাই। বাস্তবতা নাই। আইন আদালত পর্যন্ত এই মুসলিম মব সন্ত্রাসী দের কথায় সায় দেয়! কি আশ্চর্য! এই মসজিদের মাইক আর মসজিদের হুজুরা হচ্ছে এই সব নাটকের ভিত্তি । থানার জানালার শিকের ফাঁকে একজন পরেশ চন্দ্র শীলের উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে থাকার দৃশ্যটা বাংলাদেশের পুরো দুই কোটি হিন্দু এবং নির্বিবাদী ধর্ম পালন কারীদের মুখচ্ছবি ,আত্নচিৎকারের প্রতিচ্ছবি।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!