শনিবার, ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:২৮ পূর্বাহ্ন

খালেদ মহিউদ্দীনের “সাক্ষাৎকার চাই” বক্তব্য: সাংবাদিকতা নাকি রাজনৈতিক নাটক?

যমুনা রহমান
শনিবার, ১ নভেম্বর, ২০২৫

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দীন বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি জেলেও যেতে প্রস্তুত। এই বক্তব্য ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। কেউ তাকে ‘সাংবাদিকতার নীতিবিদ’ বলছেন, আবার কেউ এই ঘটনাকে দেখছেন এক ধরনের রাজনৈতিক নাটক হিসেবে। খালেদ মহিউদ্দীনের এই ঘোষণা এমন সময়ে এসেছে, যখন শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তার সাক্ষাৎকার ইতিমধ্যে বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে। রয়টার্সসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মাধ্যমের মাধ্যমে শেখ হাসিনার বক্তব্য বাংলায় অনূদিত হয়ে প্রকাশও হয়েছে। তাই নতুন করে কোনো চমকপ্রদ বক্তব্য আসার সম্ভাবনা এখন কম।
এর আগে, ২০২৪ সালের নভেম্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে টকশোতে আনতে না পারার ঘটনায় খালেদ মহিউদ্দীনকে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। সেদিন তিনি প্রকাশ্যে বলেন, নিরাপত্তার অভাবে সাদ্দামকে অনুষ্ঠানে আনা সম্ভব হয়নি।  সেটিই ছিল তার সাংবাদিকতা জীবনের এক ধরনের পরাজয়। তিনি যেহেতু একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তার ওপর বাংলাদেশের সরকারি আইন সরাসরি প্রযোজ্য নয়। তবু তিনি ঝুঁকি নেননি। পরে সেই সিদ্ধান্তকে ঢাকতে নানা অজুহাত দিয়েছিলেন। বর্তমানে খালেদ মহিউদ্দীনের “আমি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই” বক্তব্যটি কেবল সাংবাদিকতার দাবি নয়, বরং এতে রাজনৈতিক কৌশলের ছাপ।
খালেদ মহিউদ্দীন একজন পরিচিত সাংবাদিক। ডয়চে ভ্যালির বাংলা বিভাগে কাজ করার সময় তিনি দেশে বেশ পরিচিতি পান। তিনি শুধু ওই বিভাগের প্রধানই ছিলেন না, বরং জনপ্রিয় টকশো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’-এর উপস্থাপক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। সাংবাদিকতা জীবনের শুরুতে তিনি প্রথম আলোতে যোগ দেন। পরে বিডিনিউজ২৪, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করেন। ডয়চে ভ্যালিতে কাজের সময় দেশের নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার নিয়ে তিনি একজন প্রতিবাদী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি পান। শেখ হাসিনার পতনের পর, ২০২৪ সালের আগস্টে খালেদ মহিউদ্দীন ডয়চে ভ্যালির চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন নিউইয়র্কের একটি অখ্যাত পত্রিকা ঠিকানা-এর সঙ্গে। এই পরিবর্তন অনেকের কাছে তাঁর পেশাগত অবস্থানের অবনতি হিসেবে দেখা হয়। সম্প্রতি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে তিনি আবার আলোচনায় আসার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে, কাজী জেসিন নামে তুলনামূলক কম পরিচিত এক সাংবাদিক বলেছেন, “কোটি টাকা দিলেও শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেব না।” তিনিও একইভাবে আলোচনায় আসার চেষ্টা করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন বেড়েছে। হত্যা মামলা, গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুতি, অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল—সব মিলিয়ে সাংবাদিকরা এক কঠিন সময় পার করছেন। নারী সাংবাদিকদের হয়রানিও বেড়েছে। বাংলাদেশে কখনোই সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীন ছিল না। সাংবাদিক সমাজে রাজনৈতিক বিভাজন এতটাই গভীর যে, একদল বিপদে পড়লে অন্য দল পাশে দাঁড়ায় না। বরং অনেক সময় বিপদে পড়া সহকর্মীর পরিস্থিতি দেখে অন্যরা সন্তুষ্ট হয়। এই বিভাজন সাংবাদিকতার শক্তিকে দুর্বল করেছে এবং পেশার নৈতিকতা নষ্ট করেছে। খালেদ মহিউদ্দীনের “শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে চাই” বক্তব্য আসলে সাংবাদিকতার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক কৌশল। তিনি জানেন এই সাক্ষাৎকার এখনই সম্ভব নয়, কিন্তু এই ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজের জনপ্রিয়তা ও আলোচনায় উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে, কাজী জেসিন “সাক্ষাৎকার নেব না” বলে নিজেকে বিপরীত দিক থেকে প্রচারের আলোয় আনতে চাইছেন। তাঁর এই বক্তব্য কোনো নীতিগত অবস্থান নয়, বরং নিজেকে আলোচনায় রাখার চেষ্টা।
শেখ হাসিনার শাসনামলের হত্যাকাণ্ড, গুম, দুর্নীতি বা বিচার দাবির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। জনমানসে রাজনৈতিক বিতর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে উভয় পক্ষের বক্তব্যই সামনে আসতে হয়। শেখ হাসিনা এখন এমন অবস্থায় নেই যে, তাঁকে টাকা দিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে হবে। আর কাজী জেসিন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর্যায়ের সাংবাদিক নন। তাই তাঁর বক্তব্যও ফাঁপা। যদি খালেদ মহিউদ্দীন সত্যিই শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নিতে পারেন, তাহলে ৫ আগস্ট ২০২৪–এর পর প্রথমবারের মতো হাসিনার মুখোমুখি হওয়ার ঐতিহাসিক কৃতিত্ব তাঁর হবে। যেমন জিল্লুর রহমান একসময় শেখ মুজিব হত্যার দায় স্বীকার করা কর্নেল রশিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। তাই এই “আমি সাক্ষাৎকার নিতে চাই” ঘোষণা মূলত খালেদ মহিউদ্দীনের আত্মপ্রচার ও নিজের অবস্থান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা। তিনি এই নাটকীয় ঘোষণার মাধ্যমে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের একটি নিরাপদ পথও খুঁজছেন।


একই ঘরনার সংবাদ
error: Content is protected !!
error: Content is protected !!